সোনার বাজারে নতুন রেকর্ড
ভারতের বাজারে ফের সোনার দাম আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছল বুধবার। মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (MCX) প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম ১ লক্ষ ৬ হাজার ২৮৯ টাকা ছুঁয়েছে। দেশের বাজারে এমন রেকর্ড আগে দেখা যায়নি। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারেও সোনার ঝলক বেড়েছে, প্রতি আউন্স দাম সাড়ে তিন হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। ফলে লগ্নিকারীদের মধ্যে এখন প্রশ্ন—এই দামে সোনা কেনা কতটা লাভজনক হবে?
এক মাসে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি
শুধু এক দিনে নয়, গত এক মাস ধরেই সোনার দামে লাফালাফি চলছে। দেশে এক মাসে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে যেমন চাহিদা বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও এই উর্ধ্বগতির পিছনে বড় ভূমিকা রাখছে। ফলে সোনার দামে নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়া একপ্রকার সময়ের অপেক্ষাই ছিল।
উৎসবের মরশুমে চাহিদা তুঙ্গে
এ মাসের শেষ দিক থেকেই শুরু হবে উৎসবের মরশুম। নবরাত্রি থেকে শুরু করে দিওয়ালি—একাধিক উৎসবে ভারতীয় পরিবারে সোনা কেনার ঐতিহ্য রয়েছে। বাজার বিশেষজ্ঞ হর্ষল দাসানি জানাচ্ছেন, উৎসবের আগে থেকেই ডিলাররা সোনা মজুত করতে শুরু করেছেন। এতে বাজারে কৃত্রিম চাপ তৈরি হচ্ছে এবং দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকছে। এই চাহিদার বিস্ফোরণই সোনার দামে রেকর্ড গড়ার অন্যতম কারণ।
ভূ-রাজনীতির প্রভাব
শুধু উৎসব নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিও সোনার দামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন, এবং তার ফলে রাশিয়া ও চিনের দিকে ঝুঁকে পড়া—সবই প্রভাব ফেলছে বাজারে। বেজিং ও মস্কো ক্রমাগত নিজেদের ভাণ্ডারে সোনা মজুত করছে। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কও সেই পথেই এগোচ্ছে। এতে বিশ্ববাজারে সোনার দামের উপর চাপ আরও বাড়ছে। ফলে ভারতীয় গ্রাহকদের জন্য সোনা কেনা দিনে দিনে আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
ডলারের দাপট কমছে
বিশেষজ্ঞদের মতে, সোনার দামে ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ হলো ডলারের শক্তি কমে যাওয়া। ডলার যতটা দুর্বল হয়, সোনার চাহিদা ততই বাড়ে। কারণ বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ লগ্নির মাধ্যম হিসেবে সোনাকে বেছে নেন। বর্তমানে ডলারের গতি মন্থর, তাই সোনার দামেও রেকর্ড ছোঁয়ার প্রবণতা স্পষ্ট।
বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। এত বেশি দামে সোনা কিনলে ভবিষ্যতে মুনাফা আদৌ হবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। কেউ কেউ মনে করছেন, এখন সোনা কেনা মানে বিপজ্জনক স্পেকুলেশন, আবার কারও মতে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এখনও সোনা কেনা লাভজনক হতে পারে। ফলে মতভেদ তৈরি হয়েছে বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যেই।
বিশেষজ্ঞ হর্ষল দাসানির পরামর্শ
হর্ষল দাসানি জানাচ্ছেন, উৎসবের আগে সোনার দামে আরও কিছুটা বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। তিনি মনে করছেন, "গ্রাহকরা আবেগতাড়িত হয়ে সোনা কিনবেন বলেই দাম চড়া থাকবে। তবে এই সময়েই যদি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বড় কোনও পরিবর্তন ঘটে, তখন দামে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।" তাঁর মতে, ছোট বিনিয়োগকারীদের এখনই সোনার দিকে ঝুঁকতে সাবধান হওয়া উচিত।
শর্ট টার্মে ঝুঁকি, লং টার্মে ভরসা
বাজার বিশ্লেষক এনএস রামাস্বামী এ প্রসঙ্গে বলেন, "বর্তমানে সোনায় শর্ট টার্ম লগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ। উৎসবের মরশুমে দাম আরও বাড়তে পারে, তবে হঠাৎ পতনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।" তবে তাঁর মতে, দীর্ঘমেয়াদে সোনায় বিনিয়োগ সবসময়ই নিরাপদ। কারণ মুদ্রাস্ফীতি ও ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সোনা একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প।
বিনিয়োগকারীদের করণীয়
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, যাঁরা স্বল্প মেয়াদের লাভের আশায় আছেন, তাঁদের এখন সোনা থেকে দূরে থাকা ভালো। তবে যাঁদের উদ্দেশ্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, তাঁরা ধাপে ধাপে সোনা কিনতে পারেন। একসঙ্গে বড় অঙ্কে কেনার বদলে ধীরে ধীরে সোনা সংগ্রহ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এতে ঝুঁকি কমবে, আবার নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
শেষকথা
সোনার বাজারে বর্তমানে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, তা মূলত উৎসবের মরশুম, আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন এবং ডলারের দাপট কমে যাওয়ার ফল। এখনই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পদক্ষেপ করতে হবে। অন্যথায় স্বল্প মেয়াদে বিপদের ঝুঁকি থেকেই যাবে।