মহাত্মা গান্ধী একবার স্বীকার করেছিলেন যে জওহরলাল নেহরু তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন, কিন্তু প্রশাসক হিসেবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম ছিলেন। আজ যে একতাবদ্ধ এবং অখণ্ড ভারতে আমরা বাস করছি, তার ভিত্তি সর্দার প্যাটেলের দূরদৃষ্টি এবং দৃঢ় নেতৃত্ব স্থাপন করেছিল।
Sardar Vallabhbhai Patel 150th Birth Anniversary: ভারতের স্বাধীনতার গল্প যত অনুপ্রেরণাদায়ক, ততটাই জটিলও। এই গল্পে এমন একটি অধ্যায় আছে, যা প্রতিবার সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল (Sardar Vallabhbhai Patel) এর জন্মবার্ষিকীতে আবার স্মরণ করা হয় — সেই মুহূর্ত যখন ‘লৌহমানব’ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন, কিন্তু তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন যাতে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে।
আজ ৩১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ভারত তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi) ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’তে (Statue of Unity) শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং দেশকে একতা, সেবা ও ত্যাগের বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন এখনও একটাই — যদি সর্দার প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে কি ভারতের ইতিহাস অন্যরকম হতো?
গান্ধীজির প্রিয়, কিন্তু সবচেয়ে যোগ্য প্রশাসক ছিলেন প্যাটেল
মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, নেহরু আমার হৃদয়ের কাছাকাছি, কিন্তু প্রশাসনে প্যাটেলের মতো কেউ নেই। গান্ধীজির এই উক্তি থেকে স্পষ্ট যে, যেখানে নেহরু ছিলেন চিন্তাভাবনার প্রতীক, সেখানে প্যাটেল ছিলেন রাষ্ট্র গঠনের প্রকৃত কারিগর। ভারতের ৫৬২টি দেশীয় রাজ্যের একীকরণ (Integration of Princely States) অসম্ভব বলে মনে হতো, কিন্তু প্যাটেলের দক্ষ কৌশল, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং অটুট দেশপ্রেম এটিকে সম্ভব করে তুলেছিল। ভারতের ঐক্য, শাসন ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি সেই লৌহমানবই স্থাপন করেছিলেন, যাঁকে ইতিহাস “Iron Man of India” উপাধি দিয়েছে।
গান্ধীজির হত্যাকাণ্ডের পর অভিযোগ, প্যাটেল চেয়েছিলেন পদত্যাগ
গান্ধীজির হত্যাকাণ্ডের (৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) পর বিরোধীরা গুজব ছড়ায় যে প্যাটেল, যিনি তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, গান্ধীজির নিরাপত্তায় ব্যর্থ হয়েছিলেন।
গান্ধীজির প্রপৌত্র রাজমোহন গান্ধী তাঁর "Patel: A Life" বইয়ে লিখেছেন, যখন প্যাটেল এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে পারলেন, তখন তিনি অবিলম্বে পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নেহরু তাঁকে থামিয়ে দেন এবং বলেন যে আমাদের ৩০ বছরের সম্পর্ক এভাবে ভেঙে যাওয়া উচিত নয়।”
এখান থেকেই দুজনের সম্পর্কে শীতলতা আসতে শুরু করে, কিন্তু দেশের স্বার্থে প্যাটেল নীরবতা অবলম্বন করেন। ১৯৪৬ সাল ছিল সেই বছর যখন ভারতের স্বাধীনতা কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তর (Transfer of Power) কংগ্রেসের হাতে হবে, এবং কংগ্রেস সভাপতিকেই অন্তর্বর্তী সরকার (Interim Government) এর নেতৃত্ব দেওয়া হবে — অর্থাৎ তিনিই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতেন।
কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য মনোনয়নের শেষ তারিখ ২৯ এপ্রিল ১৯৪৬ নির্ধারিত হয়েছিল। কংগ্রেসের সংবিধান অনুযায়ী, কেবল প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলি (PCCs) সভাপতি পদের জন্য মনোনয়ন করতে পারত। ১৫টির মধ্যে ১২টি PCC সর্দার প্যাটেলকে মনোনীত করেছিল, যখন অবশিষ্ট তিনটি অংশ নেয়নি। কেউই জওহরলাল নেহরুর নাম প্রস্তাব করেনি। এইভাবে প্যাটেল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন — অর্থাৎ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছিল।

নেহরুর জেদ এবং গান্ধীজির হস্তক্ষেপ
কিন্তু ইতিহাস হঠাৎ মোড় নেয়। জওহরলাল নেহরু, যিনি নিজেও এই পদের আকাঙ্ক্ষা রাখতেন, পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন যে হয় আমি এক নম্বরে থাকব, অথবা সরকারে থাকব না। গান্ধীজির সামনে এটি ছিল নৈতিক দ্বিধা। তিনি অবশেষে নেহরুকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং প্যাটেলকে অনুরোধ করলেন যে তিনি তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিন।
গান্ধীজি বললেন, নেহরু দ্বিতীয় স্থান মেনে নেবেন না, এবং জাতির এখন ঐক্যের প্রয়োজন। সর্দার প্যাটেল গান্ধীজির কথা মেনে নিলেন। তিনি কোনো বিরোধিতা বা অভিযোগ ছাড়াই, নেহরুর পক্ষে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। এটিই ছিল সেই মুহূর্ত, যখন ভারতের লৌহমানব দেশহিতৈষী স্বার্থে নিজের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছিলেন।
রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং মৌলানা আজাদের অনুশোচনা
ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ পরে লিখেছিলেন, গান্ধীজি আবারও ‘গ্ল্যামারাস নেহরু’র জন্য তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগীর বলি দিয়েছিলেন। প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের প্রশাসনিক চেহারা ভিন্ন হতো। অন্যদিকে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর আত্মজীবনী “India Wins Freedom” এ স্বীকার করেছেন, এটি আমার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল যে আমি প্যাটেলকে সমর্থন করিনি। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে বিভাজনের (Partition) প্রক্রিয়া অনেক বেশি মার্জিত এবং কম সহিংস হতো।
সি. রাজাগোপালাচারী, যিনি গান্ধীজির নিকট সহযোগী ছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, গান্ধীজি জানতেন যে প্যাটেল সেরা প্রশাসক, কিন্তু তিনি নেহরুকে বেছে নিয়েছিলেন কারণ তিনি বৈদেশিক বিষয়ে বেশি দক্ষ ছিলেন। যদি নেহরু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেক বেশি শক্তিশালী হতো।
তিনি আরও যোগ করেছেন যে প্যাটেল সম্পর্কে “মুসলমানদের প্রতি কঠোর” হওয়ার ভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল, যদিও বাস্তবে তিনি সমতা ও ন্যায়ের কট্টর সমর্থক ছিলেন।
 
                                                                        
                                                                            











