হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুর জেলায় অবস্থিত শ্রী নৈনা দেবী মন্দির শক্তি, ভক্তি এবং পর্যটনের কেন্দ্র। এই প্রাচীন শক্তিপীঠ দেবী সতীর পবিত্র চোখের সাথে জড়িত এবং শ্রাবণ-নবরাত্রিতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত দর্শনের জন্য আসেন।
নয়না দেবী মন্দির: হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুর জেলায় অবস্থিত শ্রী নয়না দেবী মন্দির কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রই নয়, এটি ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যপূর্ণও। এই মন্দিরটি একটি শক্তিপীঠ হিসাবে বিখ্যাত এবং দেবীর পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত এখানে দর্শন ও পূজা-অর্চনার জন্য আসেন। মন্দিরটি গোবিন্দ সাগর হ্রদের কাছে একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, যা এখানকার মনোরম দৃশ্য এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
পৌরাণিক কাহিনী এবং দেবী সতীর তাৎপর্য
পুরাণ ও বেদ অনুসারে, দেবী সতী যজ্ঞে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, যা ভগবান শিবকে অত্যন্ত দুঃখিত করে তোলে। শোকে মুহ্যমান হয়ে শিব সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। এই নৃত্য দেখে স্বর্গলোকের দেবতারা ভীত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ এটি অনিয়ন্ত্রিত হলে ধ্বংসের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র ব্যবহার করে সতীর দেহ ৫১টি টুকরোয় বিভক্ত করে দেন।
বিশ্বাস করা হয় যে সতীর চোখ এই স্থানে পড়েছিল, এবং এই স্থানটিই বর্তমানে নয়না দেবী মন্দির হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
এরপর এই মন্দিরটি কিছু সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একজন গুর্জর বালক এটি পুনরায় আবিষ্কার করে। কথিত আছে যে বালকটি তার পশুদের চড়াতে গিয়েছিল এবং দেখেছিল যে একটি সাদা গাভী একটি পিণ্ডির উপর দুধ ঢালছে। কয়েকদিন ধরে এই দৃশ্য চলতে থাকে। এক রাতে সে দেবী নয়নার স্বপ্ন দেখে, যেখানে দেবী বলেন যে সেই পিণ্ডিটি তিনিই। এই তথ্যের ভিত্তিতে রাজা বীরচন্দ্র মন্দিরটি নির্মাণ করান এবং এটিকে নয়না দেবী নামে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মহিষাসুর বধ এবং মহিষপীঠের তাৎপর্য
শ্রী নয়না দেবী মন্দির মহিষপীঠ নামেও পরিচিত। পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর এক শক্তিশালী অসুর ছিল যাকে ভগবান ব্রহ্মা অমরত্বের বরদান দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কেবল একজন অবিবাহিত নারীর হাতেই মারা যেতে পারত। মহিষাসুর পৃথিবী এবং দেবতাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। সকল দেবতারা তাদের শক্তি একত্রিত করে দেবীর সৃষ্টি করেন, যাকে বিভিন্ন অস্ত্র ও শক্তি প্রদান করা হয়েছিল।
মহিষাসুর দেবীর সৌন্দর্য দেখে তার সাথে বিবাহের প্রস্তাব রাখে। দেবী বলেন যে যদি সে তাকে পরাজিত করতে পারে তবেই তিনি বিবাহ করবেন। যুদ্ধের সময় দেবী মহিষাসুরকে পরাজিত করেন এবং তার দুটি চোখ তুলে নেন। এরপর দেবতারা জয়ধ্বনি করেন, “জয় নয়না,” এবং এভাবেই মন্দিরটির নামও দেবীর চোখের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
মন্দিরের ভৌগোলিক তাৎপর্য
শ্রী নয়না দেবী মন্দির বিলাসপুর জেলার একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। পাহাড়ের নিচে ভক্ত भगत জিওনা মোরহ-এর সমাধিস্থলও অবস্থিত, যা ২০ শতকের শুরুতে মারা গিয়েছিলেন। মন্দিরটি জাতীয় সড়ক নম্বর ২১-এর সাথে যুক্ত।
মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য সড়কপথে উপরে ওঠা যায়, যা পাহাড়ের চারপাশে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে যায়। এছাড়াও, কেবল কারের সুবিধাও উপলব্ধ, যা ভক্তদের পাহাড়ের নিচ থেকে সরাসরি মন্দিরে নিয়ে যায়। মন্দির থেকে গোবিন্দ সাগর হ্রদের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। এই হ্রদটি ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
মন্দিরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
শ্রী নয়না দেবী মন্দির কেবল ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রতি বছর শ্রাবণ ও नवराত্রির উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্ত আসেন। মন্দিরের চারপাশে অনেক ছোট ছোট তীর্থস্থান, মঠ এবং সেবা কেন্দ্র রয়েছে, যা ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
মন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত অনেক কাহিনী এবং লোককথা স্থানীয়রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বলে আসছেন। এই মন্দির ভক্তি ও শক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
২০০৮ সালের ট্র্যাজেডি: নয়না দেবী পদদলিত
৩ আগস্ট ২০০৮ তারিখে এই মন্দিরে একটি ভয়াবহ পদদলিত (ভিড় দুর্ঘটনা) ঘটে, যেখানে অন্তত ১২৩ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে অনেক মহিলা ও শিশুও ছিল। এই ঘটনার পেছনে বিভিন্ন কারণ বলা হয়েছে:
- কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, পড়ে যাওয়া মানুষ এবং ভেঙে যাওয়া রেলিংয়ের কারণে লোকজন নিচে পড়ে যায়।
- অন্যান্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে একটি মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভক্তদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
- কিছুতে এও বলা হয়েছে যে পুলিশ ভিড় থামাতে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য লাঠিপেটা ব্যবহার করেছিল।
সেই সময় মন্দিরে প্রায় ৩০০০ ভক্ত উপস্থিত ছিলেন, যেখানে नवराত্রির দিনে ৫০,০০০ ভক্ত আসার সম্ভাবনা ছিল। এই ঘটনাটি বিশেষত শ্রাবণ মাসে ঘটেছিল। পুলিশ কর্মকর্তা দলজিৎ সিং মানহাসের মতে, অন্তত ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মৃতদের পরিবারকে ১,০০,০০০ টাকা, গুরুতর আহতদের ৫০,০০০ টাকা এবং সামান্য আহতদের ২৫,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেন। এই ঘটনা মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারকে ব্যাপক ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে অনুপ্রাণিত করে।
মন্দিরের স্থাপত্য
শ্রী নয়না দেবী মন্দিরের স্থাপত্য হিমাচল প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী শৈলীতে নির্মিত। মন্দিরের গম্বুজযুক্ত প্রধান মন্দির ভক্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানকার পবিত্র পিণ্ডি এবং দেবীর মূর্তি ভক্তদের জন্য আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। মন্দিরে অনেক ছোট ছোট প্রাঙ্গণ এবং প্রার্থনা স্থান রয়েছে।
মন্দির চত্বরে অনেক সহায়ক ভবন, ধর্মীয় গ্রন্থাগার, ভান্ডার এবং সেবা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ভক্তরা তাদের নৈবেদ্য ও দান করতে পারেন। মন্দিরের কাছে নির্মিত ছোট ছোট মঠ ও আশ্রমে সাধু এবং ভক্তিবাদী পথপ্রদর্শক বাস করেন।
বর্তমান অবস্থা ও পর্যটন
আজ শ্রী নয়না দেবী মন্দির হিমাচল প্রদেশের প্রধান তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। এখানে কেবল ভক্তরাই নয়, দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরাও আসেন। মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য সড়ক পথ এবং কেবল কার উভয়ই উপলব্ধ। গোবিন্দ সাগর হ্রদের মনোরম দৃশ্য, সবুজ বন এবং পাহাড়ী পথ ভক্ত ও পর্যটকদের অভিজ্ঞতাকে অনন্য করে তোলে।
মন্দিরের আশেপাশে অনেক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যা হিমাচল প্রদেশের লোকশিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। শ্রাবণ ও नवराত্রির উপলক্ষে মন্দিরে বিশেষ পূজা ও মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লক্ষ লক্ষ ভক্ত অংশগ্রহণ করেন।
জনসংখ্যা ও সামাজিক অবস্থা
নয়না দেবী অঞ্চলে ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ১১৬১ জন লোক বসবাস করে। এর মধ্যে ৬৩% পুরুষ এবং ৩৭% মহিলা। এখানকার গড় সাক্ষরতার হার ৮১%, যা জাতীয় গড় ৫৯.৫% থেকে বেশি। পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৮৪% এবং মহিলাদের সাক্ষরতার হার ৭৫%। এই অঞ্চলের ১১% জনসংখ্যা ৬ বছরের কম বয়সী।
শ্রী নয়না দেবী মন্দির কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রই নয়, এটি হিমাচল প্রদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং পর্যটনের প্রতীকও। পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা জড়িত এই মন্দির শক্তি, ভক্তি এবং ধর্মীয় শৃঙ্খলার এক অনন্য মিশ্রণ উপস্থাপন করে। ২০০৮ সালের দুঃখজনক ঘটনা এই বার্তা দিয়েছে যে ভক্তির সাথে সাথে সুরক্ষা এবং শৃঙ্খলাও অপরিহার্য।
আজ এই মন্দির কেবল ভক্তদের জন্যই নয়, দর্শনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার জন্যও পরিচিত। এখানে আগত লোকেরা কেবল দেবীর ভক্তিতেই মগ্ন হন না, বরং হিমাচলের মনোরম সৌন্দর্যেরও উপভোগ করেন।