ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমিয়ে তার শক্তি নীতির গতিপথ বদলেছে। চলতি অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে রাশিয়া থেকে আমদানি ৮.৪% কমেছে, যেখানে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল কেনা বেড়েছে। ছাড় কমে যাওয়া এবং আমেরিকার চাপের কারণে ভারত এখন আবার ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের উপর আস্থা রাখছে।
তেল আমদানি: ভারতের তেল বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে। চলতি অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ৮.৪% কমে গেছে, যেখানে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেনা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত ছাড় কমে যাওয়া এবং সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ভারতীয় রিফাইনারিগুলো নতুন বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। একই সাথে, আমেরিকার চাপ এবং বাণিজ্যিক আলোচনার মধ্যে ভারত তার শক্তি নীতিতে ভারসাম্য আনতে পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে এখন ওপেক (OPEC) দেশগুলির অংশীদারিত্ব আবার বাড়তে শুরু করেছে।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমেছে
এই অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৭.৫ লক্ষ ব্যারেল তেল কিনেছে। সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা প্রতিদিন ১৬ লক্ষ ব্যারেলে স্থিতিশীল ছিল, তবে এটি গত বছরের তুলনায় ১৪.২ শতাংশ কম। বাণিজ্যিক তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে রাশিয়া থেকে মোট তেল আমদানিতে ৮.৪ শতাংশ হ্রাস নথিভুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন ভারতের শক্তি নীতিতে একটি কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত। গত দু'বছরে ভারত রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি তেল কেনা দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হয়েছিল, কিন্তু এখন এই প্রবণতা মন্থর হতে দেখা যাচ্ছে।
কেন ম্লান হলো রুশ তেলের আকর্ষণ
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া এখন সেই বিশাল ছাড় দিচ্ছে না যা যুদ্ধের শুরুতে দেওয়া হচ্ছিল। আগে ভারত আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রতি ব্যারেল রুশ অপরিশোধিত তেল ২০ থেকে ৩০ ডলার সস্তায় পাচ্ছিল, কিন্তু এখন এই ছাড় কমে প্রায় ৫ থেকে ৭ ডলারে সীমিত হয়েছে। এই কারণে ভারতীয় রিফাইনারিগুলির জন্য এই চুক্তিটি এখন আগের মতো লাভজনক নয়।
দ্বিতীয় কারণ হলো সরবরাহের সমস্যা। রাশিয়া থেকে তেল পরিবহনে বিলম্ব, বীমা সংক্রান্ত জটিলতা এবং অর্থপ্রদান বিষয়ক বাধার কারণেও ভারতীয় কোম্পানিগুলি অসুবিধায় পড়েছে। এর ফলস্বরূপ, ভারতকে নতুন বিকল্প খুঁজতে হয়েছে এবং এখন রিফাইনারিগুলো আবার উপসাগরীয় দেশগুলি ও আমেরিকা থেকে তেল আমদানি বাড়াতে শুরু করেছে।
আমেরিকার চাপ ও বাণিজ্যিক চুক্তির প্রভাব
এই পুরো পরিবর্তনের পিছনে আমেরিকার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ওয়াশিংটন ভারতের উপর রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমানোর জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, রাশিয়া থেকে তেল কেনা বৃদ্ধি মস্কোকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
মার্কিন বাণিজ্য সচিব স্কট বেসেন্ট সম্প্রতি বলেছিলেন যে ভারতকে তার তেল আমদানিতে ভারসাম্য আনতে হবে এবং তাকে মার্কিন শক্তি পণ্য কেনা বাড়াতে হবে। সূত্র অনুযায়ী, আমেরিকার সাথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সম্ভাব্য শুল্ক (ট্যারিফ) ছাড়ের বিনিময়ে ভারত তেল কেনার নীতিতে এই ভারসাম্য আনতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
ওয়াশিংটনের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোও এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, রাশিয়া থেকে ভারতের ক্রমবর্ধমান কেনাকাটা পরোক্ষভাবে যুদ্ধকে তহবিল যোগাচ্ছে। এর পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে শক্তি সংক্রান্ত আলোচনা গতি পায় এবং ভারত ধীরে ধীরে মার্কিন তেল আমদানি বৃদ্ধি করতে শুরু করে।
ভারতে তেল আমদানির পরিবর্তিত ভারসাম্য
তেল ব্যবসার সাম্প্রতিক তথ্য এই পরিবর্তনের সত্যতা নিশ্চিত করে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন গড়ে ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছে, যা আগস্টের সমান হলেও, গত বছরের তুলনায় ১৪.২ শতাংশ কম ছিল।
মজার বিষয় হলো, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং নায়রা এনার্জির মতো বেসরকারি রিফাইনারিগুলো এখনও রাশিয়া থেকে কিছুটা বেশি তেল কিনছে, যেখানে সরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের কেনাকাটা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে বেসরকারি সংস্থাগুলি বাজার-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যেখানে সরকারি তেল সংস্থাগুলি কৌশলগত নির্দেশনা অনুসরণ করছে।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ভারত আমেরিকা থেকে তেল আমদানি ৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিদিন ২.১৩ লক্ষ ব্যারেলে পৌঁছেছে। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিও ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওপেক দেশগুলির অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি
ভারতের মোট তেল আমদানিতে রাশিয়ার অংশীদারিত্ব ৪০ শতাংশ থেকে কমে প্রায় ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অংশীদারিত্ব ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৫ শতাংশ হয়েছে। ওপেক (OPEC) দেশগুলির মোট অংশীদারিত্ব এখন ৪৯ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত আরও একবার ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের উপর আস্থা রাখছে।
উপসাগরীয় দেশগুলি, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ইরাক, ভারতকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তেল সরবরাহ করে বাজারে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। একই সাথে, আমেরিকা থেকে আসা শেল তেলের সরবরাহেও স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে, যার ফলে ভারতের কাছে এখন বিভিন্ন উৎস থেকে শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প রয়েছে।