বিচারপতি যশवंत ভার্মা-র বিরুদ্ধে অর্থ উদ্ধারের ঘটনা: তদন্ত রিপোর্ট ও অভিশংসনের সম্ভাবনা

বিচারপতি যশवंत ভার্মা-র বিরুদ্ধে অর্থ উদ্ধারের ঘটনা: তদন্ত রিপোর্ট ও অভিশংসনের সম্ভাবনা

এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জাস্টিস যশवंत ভার্মা-র সঙ্গে জড়িত নগদ অর্থ উদ্ধারের ঘটনাটি এবার নতুন মোড় নিয়েছে। এই মামলায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।

নয়াদিল্লি: ভারতীয় বিচার বিভাগে একটি ঐতিহাসিক মোড় আসতে চলেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি যশवंत ভার্মার বিরুদ্ধে চলা তদন্ত এবং অভিশংসনের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া গোটা দেশের আইন মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ৯ই জুলাই, ২০২৫-এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে অভিশংসনের সুপারিশ করেছেন। এই ঘটনা শুধু একজন বিচারপতির আচরণের বিষয় নয়, বরং ভারতীয় বিচার বিভাগের নৈতিকতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

আসলে ঘটনা কী?

এই পুরো ঘটনাটি ১৪ই মার্চ, ২০২৫-এর রাতে শুরু হয়, যখন দিল্লির সরকারি বাসভবনে বিচারপতি ভার্মার বাংলোতে আগুন লাগে। মিডিয়া রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, আগুনের আগে সেখানে নগদ টাকার বান্ডিল পাওয়া গিয়েছিল, যা পরে পুড়ে যায়। এই ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ঘটনার পরেই দিল্লি হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি. কে. উপাধ্যায় একটি প্রাথমিক তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২২শে মার্চ একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত কমিটির রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি

তদন্ত কমিটি বিচারপতি ভার্মার সেই বক্তব্য খারিজ করে দিয়েছে যেখানে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর বাড়িতে কোনো নগদ টাকা ছিল না। রিপোর্টে বলা হয়েছে:

  • ঘটনা স্থলে নগদ অর্থের অস্তিত্বের প্রমাণ ছিল।
  • বিচারপতি ভার্মা কখনও পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেননি, যা সন্দেহের উদ্রেক করে।
  • দিল্লি পুলিশ এবং দমকল বিভাগের কার্যকারিতা ছিল অত্যন্তA लापरোয়া।
  • কোনো পঞ্চনামা, সিলিং বা জব্দ করার মেমো তৈরি করা হয়নি।
  • কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, নগদের পরিমাণ কত ছিল, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বিচারপতি ভার্মার আচরণ এবং নীরবতাই তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

অভিশংসন: একটি দীর্ঘ এবং জটিল পথ

সংবিধানের ১২৪(৪), ২১৭ এবং ২১৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে, ভারতে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনো বিচারককে অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ করা যেতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কঠিন এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল:

  • লোকসভায় প্রস্তাব আনতে হলে ১০০ জন সাংসদের স্বাক্ষর প্রয়োজন।
  • রাজ্যসভায় এই সংখ্যা ৫০ জন সাংসদের।

যদি অধ্যক্ষ (উপরাষ্ট্রপতি) প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন, তবে একটি তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করা হয়, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং একজন সিনিয়র জুরিস্ট থাকেন। যদি কমিটি মনে করে যে অভিযোগগুলি সত্য, তবে প্রস্তাবটি উভয় সভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হতে হবে। ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো বিচারপতিকে অভিশংসনের মাধ্যমে সরানো যায়নি। উদাহরণস্বরূপ:

  • বিচারপতি ভি. রামাস্বামী (১৯৯৩): অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল, কিন্তু লোকসভায় রাজনৈতিক কারণে প্রস্তাবটি পাশ হয়নি।
  • বিচারপতি পি. ডি. দিনাকরণ এবং বিচারপতি সৌমিত্র সেন কার্যকারিতা শুরু হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন।
  • প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবটি উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু খারিজ করে দেন।

সংসদীয় প্যানেলের উদ্বেগ

২৪শে জুন, ২০২৫-এ সংসদীয় প্যানেলের বৈঠকে এই প্রশ্ন ওঠে যে, এখনো পর্যন্ত এফআইআর কেন দায়ের করা হয়নি? সাংসদরা দাবি করেন:

  • বিচারকদের জন্য আচরণবিধি (Code of Conduct) তৈরি করা হোক।
  • অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিদের কমপক্ষে পাঁচ বছর কোনো সরকারি পদ গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
  • বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হোক।

যদি এই মামলায় অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তা অগ্রসর হয়, তবে এটি ভারতীয় বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবার হবে যখন কোনো বিচারপতিকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণ করা হবে। এর ফলে দেশে বিচার বিভাগের সম্মান, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হবে।

Leave a comment