ভারতীয় খেলার ইতিহাসে কিছু নাম এমন থাকে যা সময়ের সঙ্গে আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ, যাঁকে আমরা সবাই ‘কপিল দেব’ নামে চিনি, তেমনই একটি নাম। একজন খেলোয়াড়, একজন অধিনায়ক, একজন অনুপ্রেরণা এবং একটি যুগের নাম – কপিল দেব শুধু ক্রিকেটের ময়দানে বল ও ব্যাটের ভারসাম্য ছিলেন না, তিনি ছিলেন আশা ও সাহসের জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর জীবন শুধু রেকর্ডের গণনা নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের পাঠ।
শুরুর জীবন: সাধারণ থেকে অসাধারণের দিকে
কপিল দেবের জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে পাঞ্জাবের চণ্ডীগড়ে। তাঁর পিতা রামলাল নিখাঞ্জ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মাতা রাজকুমারী নিখাঞ্জ একজন সাধারণ গৃহিণী। কপিল দেব তাঁর কৈশোরেই খেলার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ক্রিকেট তাঁর কাছে একটি খেলার চেয়ে বেশি, একটি নেশা ছিল। তিনি হরিয়ানার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলতে শুরু করেন এবং এখান থেকেই এমন এক ক্যারিয়ারের ভিত্তি স্থাপন হয়, যা ভারতকে বিশ্ব ক্রিকেট মঞ্চে গৌরব এনে দেয়।
ক্রিকেটে আগমন: শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মনোভাব
কপিল দেব ১৯৭৫ সালে হরিয়ানা দল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর দ্রুত গতির বোলিং এবং উদ্যমী ব্যাটিং শীঘ্রই তাঁকে জাতীয় নির্বাচকদের নজরে নিয়ে আসে। ১৬ অক্টোবর ১৯৭৮ সালে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফয়সালাবাদে তাঁর প্রথম টেস্ট খেলেন। যদিও প্রথম দিকের সিরিজ তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না, তবে কপিল দেব হার মানার পাত্র ছিলেন না। তিনি শীঘ্রই নিজেকে একজন 'অলরাউন্ডার' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যিনি উইকেটও নিতে পারতেন এবং প্রয়োজনে ম্যাচ জেতানো ইনিংসও খেলতে পারতেন।
সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত: ১৯৮৩ বিশ্বকাপ এবং ভারতের রাজ্যাভিষেক
১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ কপিল দেবের ক্যারিয়ার এবং ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য মাইলফলক প্রমাণিত হয়। তখন ভারতকে ক্রিকেটে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না, কিন্তু কপিলের নেতৃত্বে সবকিছু বদলে যায়। ১৮ জুন ১৯৮৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তিনি মাত্র ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের ইনিংস খেলেন। এই ইনিংসটি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সাহসী ইনিংস হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই বিশ্বকাপে ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে কাপ জেতে এবং ভারত ক্রিকেটের নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
রেকর্ডের খনি: পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি কিছু
কপিল দেব ১৩১টি টেস্ট ম্যাচে ৪৩৪টি উইকেট এবং ৫২৪৮ রান করেছেন। তিনি ২২৫টি ওয়ানডে ম্যাচে ২৫৩টি উইকেট এবং ৩৭৮৩ রান করেছেন। তিনিই প্রথম খেলোয়াড় যিনি টেস্টে ৪০০-এর বেশি উইকেট এবং ৫০০০-এর বেশি রান করেছেন। তাঁর ব্যাটিং এবং বোলিংয়ের মধ্যে ভারসাম্য তাঁকে 'পূর্ণ খেলোয়াড়'-এর বিভাগে নিয়ে আসে। তিনি ১৯৯৪ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটের মেরুদণ্ড ছিলেন।
প্রশিক্ষকের ভূমিকা: মাঠের বাইরেও নেতৃত্ব
১৯৯৯ সালে কপিল দেবকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ নিযুক্ত করা হয়। যদিও এই কার্যকাল খুব বেশি দিন চলেনি। মনোজ প্রভাকর কর্তৃক আরোপিত বাজির অভিযোগের কারণে কপিল দেব পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। যদিও এই সময়টা তাঁর জন্য কঠিন ছিল, তবুও তিনি তা কাটিয়ে উঠে নিজেকে একজন সামাজিক নেতা হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন।
সামাজিক কাজ: খেলা থেকে সমাজ সেবা
কপিল দেব ২০০৫ সালে ‘খুশি’ নামক একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য কাজ করে। দিল্লিতে 'খুশি'-র তিনটি স্কুল চলছে, যা দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। তিনি শুধু ক্রিকেটের হিরো নন, সমাজের জন্যও একজন আদর্শ।
সামরিক সেবা: আরেকটি পরিচয়
২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে কপিল দেবকে ভারতীয় আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল’-এর সম্মানসূচক পদ দেওয়া হয়। এই সম্মান তাঁর শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং অনুপ্রেরণামূলক জীবনের জন্য ছিল। তিনি প্রমাণ করেছেন যে শৃঙ্খলা শুধু সেনাবাহিনীর সংজ্ঞা নয়, বরং প্রতিটি সফল ব্যক্তির ভিত্তি।
ব্যক্তিগত জীবন: সরলতা ও ভারসাম্যের সংমিশ্রণ
কপিল দেব ১৯৮০ সালে রোমি ভাটিয়াকে বিয়ে করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান, আমিয়া দেব, ১৯৯৬ সালে জন্মগ্রহণ করে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সবসময় সরল জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে কখনও চাকচিক্য দিয়ে ঢাকেননি, বরং পরিশ্রম ও সততাকে নিজের মন্ত্র বানিয়েছেন।
কলা, সংস্কৃতি ও গল্ফে আগ্রহ
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর কপিল দেব গল্ফ খেলা শুরু করেন এবং অনেক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। তিনি লরিয়াস ফাউন্ডেশনের এশিয়া থেকে একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এই সংস্থা খেলার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনতে কাজ করে।
কপিল দেব শুধু একজন ক্রিকেটার নন, বরং ভারতের আত্মার অংশ। তিনি যে উদ্দীপনা দেখিয়েছেন, তা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেন যে একজন ব্যক্তি যদি সততা, পরিশ্রম এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়। ক্রিকেটকে তিনি শুধু খেলেননি, বরং তা জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন – এবং ভারতকে একটি নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন।