পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম দানিকোলা। এখানেই দেখা গেল এক অভিনব দৃশ্য— সম্পূর্ণ মহিলাদের উদ্যোগে আয়োজন করা হচ্ছে দুর্গোৎসব। জন্মাষ্টমীর শুভক্ষণে গ্রামের গৃহবধূরা একত্রিত হয়ে সম্পন্ন করলেন পুজোর প্রথম ধাপ, খুঁটি পূজো। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন মহিলা একসঙ্গে মেতে উঠলেন খুঁটি পূজোর আচার অনুষ্ঠানে। এ যেন গ্রামীণ জীবনে এক নতুন দিশার সূচনা।
বন্যার জল সরেনি, তবুও উচ্ছ্বাসে পূজো
দানিকোলার চারপাশ এখনও বন্যার জলে ভরা। গ্রামবাসীরা সারা বছর যে সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেন, তারই একটি প্রতিচ্ছবি এখনো স্পষ্ট। কিন্তু জলযন্ত্রণা সত্ত্বেও উৎসবের আনন্দে ভাটা পড়েনি। গ্রামের মহিলারা সংসারের কাজ, সন্তান সামলানো, এমনকি কৃষিকাজের মাঝেই সময় বের করে দুর্গার আরাধনায় মেতেছেন। একদিকে বন্যার ধকল, অন্যদিকে পুজোর প্রস্তুতি— দুই দিক সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে।
গৃহবধূরাই রূপকথার দশভূজা
রুমা, ছবি, কল্পনা, সোনামণি, মিনারা— সকলে এই গ্রামের সাধারণ গৃহবধূ। তবে দৈনন্দিন লড়াইয়ে তাঁরা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই পুরুষদের থেকে। সংসারের কাজ শেষ করে অনেকেই মাঠে কৃষিকাজেও দক্ষ। যেন এক হাতে সংসার, অন্য হাতে চাষবাস। এবার সেই শক্তিই তাঁরা উৎসর্গ করলেন দুর্গার আরাধনায়। গ্রামের মানুষের চোখে এই মহিলারা আজ বাস্তবের ‘দশভূজা’।
দ্বিতীয় বর্ষে প্রবেশ করল মহিলা পরিচালিত পূজো
২০২৪ সালে প্রথম সূচনা হয়েছিল এই উদ্যোগের। সে বছরই মহিলাদের একক প্রচেষ্টায় দুর্গাপুজো ঘিরে হয়েছিল যথেষ্ট সাড়া। এবার দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়ে আয়োজন হয়েছে আরও বড়সড়। জন্মাষ্টমীর দিন গ্রামের মাঠে মহা ধুমধামের সঙ্গে সম্পন্ন হল খুঁটি পূজো। গ্রামের মহিলাদের মতে, এই পূজো শুধু দেবীর আরাধনা নয়, এটি তাঁদের ঐক্য, শক্তি ও আত্মসম্মানের প্রতীক।
নেতৃত্বে গৃহবধূ, সঙ্গে জন প্রতিনিধি
পুজো কমিটির অন্যতম মুখ রুমা ভুঁইয়া জানালেন, এই উৎসবের মূল অর্থ আসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বরাদ্দ টাকা থেকে। মাসে মাসে মহিলারা যে সরকারি আর্থিক সহায়তা পান, তার থেকেই কিছুটা বাঁচিয়ে রাখা হয়। সেই সঞ্চিত টাকাই এখন পুজোর তহবিল। পাশাপাশি, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান ছবি বাগরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন উদ্যোগে। ফলে গ্রাম জুড়ে মহিলাদের এক অদ্ভুত উৎসাহ ছড়িয়ে পড়েছে।
তিন লক্ষ টাকার বাজেট, তবুও আত্মনির্ভরশীলতা
এই বছরের দুর্গোৎসবের জন্য বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। অর্থ জোগাড়ের মূল ভরসা মহিলাদের সঞ্চয়। সরকারি প্রকল্পের টাকা থেকে বাঁচানো এই অর্থ তাঁদের কাছে একদিকে যেমন আর্থিক সহায়তা, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কোনও কর্পোরেট স্পনসর নয়, কোনও বড় ব্যবসায়ীর দান নয়— সম্পূর্ণ নিজের জমানো অর্থে এই পুজো আয়োজন করছেন তাঁরা। এতে আত্মনির্ভরশীলতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে।
বন্যা কবলিত গ্রামে পুজোর আলাদা উন্মাদনা
দানিকোলা গ্রাম প্রতি বছর বন্যার ধকল সামলায়। জলযন্ত্রণা, জমি নষ্ট হওয়া, ফসলের ক্ষতি— সবকিছুর মাঝেও আনন্দ খুঁজে নেয় মানুষ। তাই দুর্গোৎসব তাঁদের কাছে কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এক বড় সামাজিক মিলনক্ষেত্র। স্থানীয়দের বক্তব্য, এই পুজো তাঁদের জীবনে আলাদা উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছে। বন্যার হতাশা ভুলে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
উৎসবের মঞ্চে মাতৃশক্তির জয়গান
শুধু পূজা নয়, এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এক অঘোষিত বার্তাও ছড়িয়ে পড়ছে— নারী মানেই শক্তি। সংসার সামলানো থেকে মাঠে শ্রম, আবার সামাজিক উৎসবের নেতৃত্ব— প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহিলারা নিজেদের প্রমাণ করছেন। দানিকোলা গ্রামের সর্বজনীন দুর্গোৎসব আজ তাই কেবল এক গ্রামের গর্ব নয়, বাংলার গ্রামীণ নারীদের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক।