জার্মানির আইনবিদ ও পদার্থবিদ ১৭৪৫ সালে লেডেন জার আবিষ্কার করেছিলেন। এটি ছিল প্রথম কার্যকরী কনডেন্সার, যা বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় এবং আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের বিকাশে বিপ্লব এনেছিল।
ক্যাপাসিটর: ইওয়াল্ড জর্জ ভন ক্লেইস্ট (১০ জুন ১৭০০ - ১১ ডিসেম্বর ১৭৪৮) ছিলেন জার্মানির একজন বিখ্যাত আইনবিদ, লুথেরান ধর্মগুরু এবং পদার্থবিদ, যিনি লেডেন জার (Leyden Jar) আবিষ্কারের জন্য পরিচিত। বৈদ্যুতিক বিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভন ক্লেইস্ট বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় করার জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক সময়ে ক্যাপাসিটর (Capacitor) নামে পরিচিত।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
ভন ক্লেইস্ট জার্মানির পোমেরানিয়া অঞ্চলের ভিসেভোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা, ইওয়াল্ড জোয়াকিম ভন ক্লেইস্ট, ছিলেন জেলার প্রশাসক। ইওয়াল্ড লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেছিলেন। কথিত আছে যে লেডেনে অধ্যয়নের সময় তিনি উইলেম 'স গ্র্যাভেসান্ডে-এর প্রভাবে এসে বিদ্যুৎ বিজ্ঞানে আগ্রহ তৈরি করেন।
১৭২২ থেকে ১৭৪৫ সাল পর্যন্ত, ভন ক্লেইস্ট সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট ক্যাথিড্রাল, কামিয়েন পোমার্স্কির ডিন ছিলেন এবং পরে কোসলিনের রয়্যাল কোর্ট অফ জাস্টিসের সভাপতি হন। তিনি বার্লিন বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যও ছিলেন।
ক্যাপাসিটর এবং লেডেন জার আবিষ্কার
ভন ক্লেইস্ট ১১ অক্টোবর ১৭৪৫ তারিখে স্বাধীনভাবে ক্লেইস্টিয়ান জার আবিষ্কার করেছিলেন। এই জার বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় করতে সক্ষম ছিল। তিনি এই আবিষ্কারের কথা বার্লিনের বিজ্ঞানীদের একটি দলকে জানান এবং এই তথ্য লেডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছায়। সেখানে পিটার ভ্যান মুশেনব্রোক এটিকে আরও উন্নত করেন এবং এটি লেডেন জার নামে বিখ্যাত হয়।
লেডেন জার ছিল বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় করার প্রথম কার্যকরী যন্ত্র। এতে একটি কাঁচের জার থাকত, যা জল বা অন্যান্য পরিবাহী পদার্থ দিয়ে ভরা হত। ভন ক্লেইস্ট আবিষ্কার করেছিলেন যে জারের তার স্পর্শ করলে বিদ্যুতের একটি তীব্র স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হয়। এই আবিষ্কার বৈদ্যুতিক সঞ্চয় এবং বৈদ্যুতিক বর্তনীর (electrical circuits) অধ্যয়নে বিপ্লব এনেছিল।
ক্যাপাসিটরের ব্যবহার
ক্যাপাসিটর, যা পূর্বে কনডেনসার (Condenser) নামে পরিচিত ছিল, দুটি কাছাকাছি কিন্তু পৃথক পৃষ্ঠের উপর বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চয় করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় ইলেকট্রনিক উপাদান এবং এর উপযোগিতা ধারকত্ব (Capacitance) দ্বারা নির্ধারিত হয়।
একটি ক্যাপাসিটরে দুটি পরিবাহী থাকে, যা প্রায়শই ধাতব প্লেটের আকারে হয় এবং একটি অন্তরক (dielectric) দ্বারা পৃথক থাকে। কাঁচ, প্লাস্টিক, সিরামিক বা বায়ুর মতো ডাইইলেকট্রিক ক্যাপাসিটরের ধারকত্ব বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যখন ক্যাপাসিটরের টার্মিনালে ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয়, তখন একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং প্লেটগুলিতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ জমা হয়।
ক্যাপাসিটরগুলি কারেন্ট সীমিতকরণ, ফ্রিকোয়েন্সি নির্বাচন, ফিল্টার নেটওয়ার্ক এবং শক্তি সঞ্চয়ে ব্যবহৃত হয়। একটি আদর্শ ক্যাপাসিটর শক্তি অপচয় করে না, যদিও একটি বাস্তব ক্যাপাসিটর সামান্য পরিমাণ শক্তি হারাতে পারে।
ক্যাপাসিটরের উন্নয়ন ও ইতিহাস
১৭৪০-এর দশকে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে জল ভর্তি কাঁচের জারে বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় করা যায়। ভন ক্লেইস্ট ১৭৪৫ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তাঁর পরে, পিটার ভ্যান মুশেনব্রোক লেডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি নিয়ে আরও গবেষণা করেন।
ড্যানিয়েল গ্র্যালাথ প্রথমবার কয়েকটি জারকে সমান্তরালভাবে সংযুক্ত করে চার্জ সঞ্চয় ক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। পরে, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন লেডেন জার পরীক্ষা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে চার্জটি জারের কাঁচের স্তরে সঞ্চিত হয়, জলে নয়।
১৭৪৭ সালে, জারটি ভিতরে এবং বাইরে ধাতব ফয়েল দিয়ে প্রলেপ দিয়ে এবং মুখে একটি স্থান রেখে তৈরি করা হয়েছিল। এভাবেই প্রাথমিক ক্যাপাসিটর বিদ্যুৎ বিজ্ঞানে স্থায়ী অবদান রেখেছিল।
ক্যাপাসিটরের প্রকারভেদ
ক্যাপাসিটর বিভিন্ন ধরণের হয়:
- এয়ার ক্যাপাসিটর (Air Capacitor): প্রাথমিক পরীক্ষাগুলিতে ব্যবহৃত হত।
- পেপার ক্যাপাসিটর (Paper Capacitor): ১৯ শতকের শেষের দিকে টেলিফোন এবং বেতার যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হত।
- সিরামিক ক্যাপাসিটর (Ceramic Capacitor): উচ্চ ভোল্টেজ এবং ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাপ্লিকেশনের জন্য।
- মাইকা ক্যাপাসিটর (Mica Capacitor): রেডিও ট্রান্সমিশন এবং রিসেপশনে ব্যবহৃত হত।
- প্লাস্টিক ফিল্ম ক্যাপাসিটর (Plastic Film Capacitor): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিকশিত হয়েছিল।
- ট্যানটালাম এবং অ্যালুমিনিয়াম ইলেকট্রোলাইটিক ক্যাপাসিটর: উচ্চ শক্তি সঞ্চয় ক্ষমতা।
- সুপারক্যাপাসিটর (Supercapacitor): ১৯৫৭ সালে এইচ. বেকার কর্তৃক বিকশিত, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন শক্তি সঞ্চয়।
- এমওএস ক্যাপাসিটর (MOS Capacitor): আধুনিক ডিআরএএম (DRAM) এবং ইমেজ সেন্সর প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
কার্যপ্রণালীর নীতি
ক্যাপাসিটরের মূল নীতি হল ধারকত্ব (C = Q/V)। এর মানে হল যে কোনও প্লেটে সঞ্চিত চার্জ (Q) এবং তাদের মধ্যে ভোল্টেজ (V) এর অনুপাত দ্বারা ধারকত্ব নির্ধারিত হয়। প্লেটগুলির নৈকট্য এবং ডাইইলেকট্রিকের প্রকৃতি ধারকত্বকে প্রভাবিত করে।
একটি সাধারণ উদাহরণস্বরূপ, আকাশে মেঘ এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠের মধ্যে সঞ্চিত স্থির চার্জও একটি প্রাকৃতিক ক্যাপাসিটরের মতো কাজ করে। যখন বায়ুর ব্রেকডাউন ভোল্টেজ অতিক্রম করে, তখন বিদ্যুৎ চমকায়।
ক্যাপাসিটর ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ, শক্তি সঞ্চয়, ফিল্টারিং, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নির্বাচন, ডিজিটাল মেমরি এবং শক্তি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আধুনিক ব্যবহার
আজ ক্যাপাসিটরগুলি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক এবং ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহৃত হয়:
- সার্কিট ফিল্টারিং এবং ভোল্টেজ স্থিতিশীলকরণ
- রেডিও এবং রেজোন্যান্ট সার্কিট
- ডিজিটাল কম্পিউটারের ডিআরএএম (DRAM) মেমরি
- সৌর এবং শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থা
- ইমেজ সেন্সর এবং সিসিডি (CCD) ডিভাইস
- সুপারক্যাপাসিটর-ভিত্তিক শক্তি সঞ্চয়
ক্যাপাসিটরের আধুনিক নকশাগুলি আরও কম্প্যাক্ট, উচ্চ ধারকত্ব এবং উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি অপারেশনের জন্য উপযুক্ত।
ইওয়াল্ড জর্জ ভন ক্লেইস্ট লেডেন জার আবিষ্কার করে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চয় এবং ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তাঁর গবেষণা ক্যাপাসিটরের উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যা আজ আধুনিক সার্কিট, ডিজিটাল মেমরি এবং শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য উপাদান।