কেরলের নার্স নিমিষা প্রিয়াকে ইয়েমেনে তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদারকে হত্যার অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হবে। তাঁর স্বামী-মেয়ের এখনও বড় ধরনের অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষা, কারণ ১৬ই জুলাই ঘনিয়ে আসছে।
নিমিষা প্রিয়া: ইয়েমেনের কারাগারে বন্দী ভারতীয় নার্স নিমিষা প্রিয়াকে ১৬ই জুলাই ফাঁসি দেওয়ার কথা রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর ইয়েমেনি ব্যবসায়িক অংশীদারকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলাটি শুধু আইনি নয়, মানবিক সংবেদনশীলতার সঙ্গেও জড়িত। ভারতে তাঁর ১৩ বছর বয়সী মেয়ে এবং স্বামীর এখনও কোনও অলৌকিক ঘটনার আশা রয়েছে।
কেরলের নার্স, ইয়েমেনের স্বপ্ন এবং বেদনাদায়ক মোড়
কেরলের বাসিন্দা নিমিষা প্রিয়া তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার জন্য বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে, ১৯ বছর বয়সে তিনি নার্সিং ডিপ্লোমা নিয়ে ইয়েমেনে যান, যেখানে তিনি সানার একটি সরকারি হাসপাতালে চাকরি পান। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল।
বিয়ে, পরিবার এবং আবার ইয়েমেনে প্রত্যাবর্তন
তিন বছর পর নিমিষা বিয়ের জন্য ভারতে ফিরে আসেন এবং অটোচালক টমি থমাসকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে আবার ইয়েমেনে ফিরে যান। সেখানে তাঁদের একটি মেয়ে হয়, কিন্তু সংসার চালাতে সমস্যা হতে শুরু করে। স্বামী থমাস ২০১৪ সালে মেয়ের সঙ্গে ভারতে ফিরে আসেন।
মেয়েকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা: ক্লিনিকের শুরু
মেয়ে থেকে দূরে থাকা নিমিষা তাঁর আয় বাড়ানোর জন্য একটি মেডিকেল ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ইয়েমেনের আইন অনুসারে, একজন বিদেশি নাগরিককে স্থানীয় নাগরিকের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে হয়। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় মাহদি নামক এক ইয়েমেনি নাগরিকের সঙ্গে। মাহদি অংশীদারিত্বের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
মাহদির ষড়যন্ত্র এবং ক্লিনিকের দখল
ভারতে এক সফরের সময় মাহদি গোপনে নিমিষার বিয়ের ছবি চুরি করে। ইয়েমেনে ফিরে তিনি ক্লিনিকটি দখল করে নেন এবং দাবি করতে শুরু করেন যে তিনি নিমিষার স্বামী। তিনি ক্লিনিক থেকে হওয়া আয় আত্মসাৎ করেন এবং নিমিষাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে শুরু করেন।
পাসপোর্ট জব্দ, পুলিশের কাছে অভিযোগ এবং গ্রেপ্তার
মাহদি নিমিষার পাসপোর্টও জব্দ করেন, যাতে তিনি দেশ ত্যাগ করতে না পারেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে নিমিষা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাঁকেই জেলে পাঠানো হয়। ছয় দিন পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেও মাহদির অত্যাচার আরও বেড়ে যায়।
বেহুশ করার ওষুধ এবং তারপর মৃত্যু
এক জেল ওয়ার্ডেনের পরামর্শে, পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার জন্য নিমিষা মাহদিকে বেহুশ করার ওষুধ দেন। কিন্তু মাহদি মাদকাসক্ত ছিলেন, যার কারণে প্রথমবার ওষুধের প্রভাব হয়নি। দ্বিতীয়বার ডোজ বেশি হয়ে যাওয়ায় মাহদির মৃত্যু হয়।
দেহের টুকরো এবং গ্রেপ্তার
অভিযোগ অনুসারে, নিমিষা লাশের টুকরো করে পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেন এবং পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ধরা পড়েন এবং ২০২০ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল এবং ব্যর্থ প্রচেষ্টা
ভারতে তাঁর পরিবার ইয়েমেনের উচ্চ আদালতে আপিল করে, কিন্তু ২০২৩ সালে তা খারিজ হয়ে যায়। ২০২৪ সালে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের শীর্ষ রাজনৈতিক পরিষদ ফাঁসির অনুমোদন দেয়।
রক্তের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণই এখন শেষ রাস্তা
ইয়েমেনের শরিয়া আইন অনুসারে, দোষীকে ক্ষমা করার একমাত্র উপায় হল 'ব্লাড মানি' দেওয়া অর্থাৎ মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। নিমিষার পরিবার ব্লাড মানির জন্য ১০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত প্রস্তাব করেছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকা মাহদির আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষমা পাওয়া যায়নি।
ভারতে আশা এবং আবেদন
ভারতে 'সেভ নিমিষা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল' নামে একটি দল গঠন করে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকও এই মামলার ওপর নজর রাখছে। কিন্তু সময় খুব কম। ১৬ই জুলাই নিমিষাকে ফাঁসি দেওয়ার কথা।
১৩ বছর বয়সী মেয়ের আবেদন
নিমিষার ১৩ বছর বয়সী মেয়ে প্রতি মঙ্গলবার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এবং একই প্রশ্ন করে: "মা, তুমি কবে আসবে?" স্বামী থমাস বলছেন, এখনও তাঁদের কোনও অলৌকিক ঘটনার আশা রয়েছে।