ভারতীয় বিজ্ঞাপনের কিংবদন্তি পীযূষ পাণ্ডে প্রয়াত: রেখে গেলেন অবিস্মরণীয় অবদান

ভারতীয় বিজ্ঞাপনের কিংবদন্তি পীযূষ পাণ্ডে প্রয়াত: রেখে গেলেন অবিস্মরণীয় অবদান
সর্বশেষ আপডেট: 2 ঘণ্টা আগে

ভারতীয় বিজ্ঞাপনের গুরু পীযূষ পাণ্ডে ৭০ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি ফেভিকল, হাচে-এর পাগ এবং 'আবকি বার, মোদি সরকার' সহ বেশ কিছু স্মরণীয় প্রচারণা তৈরি করেছিলেন। তাঁর সৃজনশীলতা ভারতীয় বিজ্ঞাপন জগতে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।

নয়াদিল্লি: ভারতীয় বিজ্ঞাপন জগতের কিংবদন্তি পীযূষ পাণ্ডে ৭০ বছর বয়সে মারা গেছেন। পাণ্ডে তাঁর অনন্য হাস্যরস, মানবিক স্পর্শ এবং স্থানীয় ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতীয় বিজ্ঞাপনের দিক পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর তৈরি ফেভিকল এবং হাচে-এর পাগ-এর মতো প্রচারণা আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। পাণ্ডে হিন্দি এবং স্থানীয় প্রবাদ-প্রবচনকে মূলধারার বিজ্ঞাপনে এনে ভারতীয় বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ব্যাকরণ বদলে দিয়েছিলেন। কানস লায়নসের মর্যাদাপূর্ণ লায়ন অফ সেন্ট মার্ক পুরস্কার প্রাপক প্রথম এশীয় হিসেবে, পাণ্ডে ভারতীয় বিজ্ঞাপনকে বিশ্ব মঞ্চে পরিচিতি দিয়েছিলেন।

কেমন ছিল তাঁর প্রারম্ভিক জীবন

পীযূষ পাণ্ডের জন্ম জয়পুরে। শৈশবেই বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে তাঁর যুক্ততা শুরু হয়েছিল, যখন তিনি এবং তাঁর ভাই প্রসূন পাণ্ডে রেডিও জিঙ্গেলসে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে পাণ্ডে ক্রিকেট, চা চাখা এবং নির্মাণ কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে ওগিলভি অ্যান্ড ম্যাথার ইন্ডিয়া (বর্তমানে ওগিলভি ইন্ডিয়া)-তে যোগদানের পর তিনি তাঁর কর্মজীবনের দিশা পান। ২৭ বছর বয়সে তিনি ইংরেজি এবং অভিজাত নন্দনতত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞাপন শিল্পে পা রেখেছিলেন এবং ভারতীয় গ্রাহকদের ভাষায় কথা বলা প্রচারণা তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।

পাণ্ডের কর্মজীবন

পাণ্ডে তাঁর কর্মজীবনে অনেক স্মরণীয় প্রচারণা তৈরি করেছিলেন। এশিয়ান পেইন্টসের "হর খুশি মেঁ রং লায়ে", ক্যাডবেরির "কুছ খাস হ্যায়", ফেভিকলের বিখ্যাত "এগ" ফিল্ম এবং হাচে-এর পাগ বিজ্ঞাপন তাঁর কাজের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাঁর প্রচারণা শুধুমাত্র পণ্য বিক্রি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি এবং স্থানীয় অনুভূতিকেও ফুটিয়ে তুলেছিল। তিনি হাস্যরস, উষ্ণতা এবং মানবতাকে একত্রিত করে বিজ্ঞাপনগুলিকে সমাজের কাছাকাছি এনেছিলেন। তাঁর একজন সহকর্মী বলেছিলেন যে পাণ্ডে শুধুমাত্র ভারতীয় বিজ্ঞাপনের ভাষাই পরিবর্তন করেননি, বরং এর ব্যাকরণকেও নতুন রূপ দিয়েছিলেন।

ওগিলভি ইন্ডিয়াতে অবদান

ওগিলভি ইন্ডিয়াতে যোগদানের পর পাণ্ডে সৃজনশীল বিভাগে নিজের জায়গা তৈরি করেন। তিনি জাতীয় সৃজনশীল পরিচালক, কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান (ভারত) এবং গ্লোবাল চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে, ওগিলভি ইন্ডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছিল। তিনি বহু প্রজন্মের সৃজনশীল পেশাদারদের প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।

হিন্দি এবং স্থানীয় প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার

পাণ্ডের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল যে তিনি হিন্দি এবং স্থানীয় প্রবাদ-প্রবচনকে মূলধারার বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বিক্রির মাধ্যম নয়, এটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করারও একটি উপায় হতে পারে। তিনি সবসময় বলতেন যে সৃজনশীলতার উদ্দেশ্য কেবল দর্শকদের প্রভাবিত করা নয়, বরং তাদের অনুভব করানো এবং সংযুক্ত করাও হওয়া উচিত।

নিজের কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও পাণ্ডে সবসময় বিনয়ী ছিলেন। তিনি নিজেকে একটি দলের অংশ মনে করতেন এবং তাঁর অর্জনগুলো ভাগ করে নিতেন। একজন উৎসাহী ক্রিকেটার হিসেবে তিনি বিজ্ঞাপনের তুলনা দলীয় খেলার সঙ্গে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ব্রায়ান লারা একা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য জিততে পারেন না। তাহলে আমি কে?” তাঁর নেতৃত্বে, ওগিলভি ইন্ডিয়া এমন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল যেখানে তরুণ সৃজনশীলদের মৌলিকতা এবং পেশাদার দক্ষতা শেখানো হত।

বৈশ্বিক পরিচিতি 

২০১৮ সালে পাণ্ডে এবং তাঁর ভাই প্রসূন পাণ্ডে কানস লায়নস ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অফ ক্রিয়েটিভিটিতে মর্যাদাপূর্ণ লায়ন অফ সেন্ট মার্ক পুরস্কার লাভ করেন। এই সম্মান তাঁদের সারাজীবনের কাজকে স্বীকৃতি দেয়, যা ভারতীয় গল্প বলার শিল্পকে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাণ্ডের সৃজনশীলতা ভারতীয় বিজ্ঞাপনকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে পরিচিতি এনে দিয়েছিল এবং নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞাপন পেশাদারদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল।

পাণ্ডে তাঁর কাজে সবসময় আবেগ এবং সত্যের উপর জোর দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনো বিজ্ঞাপন দর্শকের হৃদয়ে পৌঁছানো উচিত। তিনি তরুণ সৃজনশীলদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মৌলিকতার মূল্যে কেবল প্রযুক্তি বা প্রবণতার পেছনে ছুটবেন না। তিনি বলতেন, "কোনো না কোনোভাবে, আপনাকে হৃদয় স্পর্শ করতে হবে। কোনো দর্শক আপনার কাজ দেখে এটা বলবে না, 'তারা এটা কীভাবে করল?' তারা বলবে, 'আমার এটা ভালো লেগেছে।'"

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে অবদান

পীযূষ পাণ্ডে ভারতের অন্যতম স্মরণীয় রাজনৈতিক স্লোগান — “আবকি বার, মোদি সরকার” — তৈরিতেও অবদান রেখেছিলেন। এই স্লোগান ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর বোঝাপড়া এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তাঁর সৃজনশীলতা কেবল বিজ্ঞাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তাগুলিকেও মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।

Leave a comment