রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ও জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের মধ্যে চলমান নিয়োগ বিতর্ক নতুন মাত্রা পেল। হুগলির কামারপুকুরের এক প্রধান শিক্ষিকা, চন্দনা ভুঁইকে ৫৯ বছর বয়সে শাস্তি হিসেবে অন্য স্কুলে সাধারণ শিক্ষিকা হিসেবে বদলি করার সিদ্ধান্ত হাইকোর্টে খারিজ হয়েছে। ২০১৬ থেকে রাজ্যের ২০টি জেলায় কোনও প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের কার্যক্রম নেই। এই পরিস্থিতিতে চেয়ারপার্সনের পদক্ষেপকে হাইকোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে।
বেসরকারি সংস্থা নিয়োগ তালিকা তৈরি
বেসরকারি সংস্থা বসু অ্যান্ড সন্সকে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে। সংস্থার মূল মালিক মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার ছেলেকে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। মামলাকারীদের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের অধিকার থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ তালিকা করার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
হাইকোর্টের জিজ্ঞাসা: কারা পরিচালনা করছে সংস্থা?
ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্র প্রশ্ন তুলেছেন, যে সংস্থাকে নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটি কারা পরিচালনা করছেন। জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের কাজ না থাকলেও এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে ছাড়ার আইনি বৈধতা কি আছে, তা বিচারকরা জানতে চেয়েছেন।
প্রধান শিক্ষিকার বদলি রায়
চন্দনা ভুঁইকে বদলি করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার আইনজীবীরা যুক্তি তোলেন, ৫৭ বছর বয়সের পর কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে বদলি করা যায় না। এছাড়া ছাত্রকে মারধরের অভিযোগের লিখিত প্রমাণও কাউন্সিল প্রদান করতে পারেনি। হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ এই যুক্তি মেনে প্রধান শিক্ষিকার বদলি রায় স্থগিত করেছে।
চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ
আইন অনুযায়ী, শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব সমষ্টিগত হওয়া উচিত, ব্যক্তিগত নয়। হাইকোর্টের বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ বলেছেন, কাউন্সিল না থাকলেও চেয়ারপার্সন রয়েছেন—তবে চেয়ারপার্সনের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। এই রায়ের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রাথমিকের ৩২ হাজার নিয়োগ মামলার প্রভাব
২০১৬ থেকে জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিল না থাকায় প্রাথমিকের ৩২ হাজার চাকরির নিয়োগ বাতিল সংক্রান্ত মামলাতেও বেসরকারি সংস্থার তৈরি তালিকা কতটা আইনি বৈধ হবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। মামলাকারীর পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে জানিয়েছেন, এই তালিকাগুলো জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত।
নিয়োগ দুর্নীতি ও আইনগত জটিলতা
মামলার তথ্য অনুযায়ী, বহু বছরের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেলা কাউন্সিলের কার্যকর ভূমিকা ছিল না। অবৈধভাবে চেয়ারম্যান বা বেসরকারি সংস্থার দ্বারা নিয়োগ তালিকা তৈরি হওয়ায় নিয়োগ দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব বেড়েছে। আদালত এই জটিল পরিস্থিতি সমাধান করতে আরও তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে।
শিক্ষকদের অধিকার ও সরকারি দায়িত্ব
এই পরিস্থিতি শিক্ষকদের অধিকার সুরক্ষার প্রশ্নে গুরুতর ইঙ্গিত দিচ্ছে। চেয়ারম্যান বা অন্য কোনও ব্যক্তির একক সিদ্ধান্তে শিক্ষককে বদলি করা, বিশেষ করে বয়সসীমার পরে, আইনত অনুমোদিত নয়। বিচারপতির রায়ে স্পষ্ট হয়েছে, শিক্ষকদের চাকরি ও বদলি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে সমষ্টিগত এবং স্বচ্ছভাবে করা আবশ্যক।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
হাইকোর্টের রায় প্রমাণ করছে, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও আইনি নিয়মের প্রাধান্য অপরিহার্য। জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের ভূমিকা পুনঃস্থাপন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে আইনানুগভাবে পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে, বেসরকারি সংস্থা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের কাজ করানো কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে নতুন নীতি প্রণয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।