ভারতের সাংস্কৃতিক ও মঞ্চ ইতিহাসের একটি যুগের অবসান হল। প্রখ্যাত মণিপুরী থিয়েটার পরিচালক, লেখক, কবি এবং নাট্যকার রতন থিয়াম ৭৭ বছর বয়সে মারা গেছেন।
Ratan Thiyam Death: ভারতীয় থিয়েটারের জগতে শোকের ছায়া। থিয়েটারের কিংবদন্তী এবং মণিপুরের প্রখ্যাত নাট্যকার, পরিচালক, কবি ও লেখক রতন থিয়াম ৭৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার পর থিয়াম ইম্ফলের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় সংস্কৃতি, থিয়েটার এবং সাহিত্য জগতে গভীর ক্ষতি হয়েছে।
ভারতীয় মঞ্চের একটি যুগের সমাপ্তি
রতন থিয়াম ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পী, যিনি ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা এবং দর্শনকে আধুনিক মঞ্চে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর নাটকে ভারতীয়ত্বের প্রতিধ্বনি এবং সমসাময়িক সমাজের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলির প্রতিফলন দেখা যেত। কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ তাঁর ছবি শেয়ার করে তাঁর মৃত্যু সংবাদটি জানান এবং তাঁকে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে অভিহিত করেন।
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং রতন থিয়ামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, রতন থিয়ামের শিল্পে মণিপুরের আত্মা বাস করত। তিনি কেবল একজন নাট্যকর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন মণিপুরী সংস্কৃতির বাহক। ভারতীয় থিয়েটারের জন্য তাঁর অবদান অমূল্য।
প্রাথমিক জীবন এবং পারিবারিক পটভূমি
রতন থিয়াম ১৯৪৮ সালে মণিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের একজন বিখ্যাত শিল্পী। শিল্পের বীজ তাঁর জীবনে শৈশব থেকেই বপন করা হয়েছিল। পড়াশোনা এবং শিল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ তাঁকে মঞ্চের দিকে আকৃষ্ট করে। কবিতা, চিত্রাঙ্কন এবং ছোট গল্পের মাধ্যমে তাঁর সৃজনশীলতার শুরু। এর পরে তিনি একজন নাট্য সমালোচক হিসাবেও সক্রিয় ছিলেন।
কিন্তু মঞ্চের প্রতি তাঁর আসল ভালোবাসা ছিল। ধীরে ধীরে তিনি নিজে নাটক লেখা ও পরিচালনা করতে শুরু করেন। তাঁর কাজে ভারতীয় ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা এবং সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাগুলির গভীর মিশ্রণ দেখা যায়।
‘থিয়েটার অফ রুটস’ এর প্রধান স্তম্ভ
১৯৭০-এর দশকে যখন ভারতীয় মঞ্চে পশ্চিমা প্রভাব প্রবল ছিল, তখন রতন থিয়াম ‘থিয়েটার অফ রুটস’ আন্দোলনকে নতুন দিশা দেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল – ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা এবং দর্শনকে থিয়েটারের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা। তিনি ভারতীয় মিথ, বেদ, উপনিষদ, লোককথা এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে তাঁর নাটকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অনন্য শৈলী তৈরি করেন। তাঁর উপস্থাপনায় অভিনয়, শব্দ, আলো এবং মঞ্চ সজ্জার সমন্বয় দর্শকদের এক अद्भुत অভিজ্ঞতা দিত।
স্মরণীয় নাটক এবং অmit छाप
রতন থিয়াম পরিচালিত অনেক নাটক থিয়েটার প্রেমীদের জন্য কালজয়ী হয়ে উঠেছে। কিছু প্রধান নাটক হল:
- উত্তর প্রিয়দর্শী – অশোকের জীবন ও আত্মানুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে এই নাটকটি তাঁর সেরা কাজগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হয়।
- কর্ণভারম – মহাভারতের চরিত্র কর্ণের দ্বিধা এবং সামাজিক অবিচারের উপর কেন্দ্রিত।
- দ্যা কিং অফ ডার্ক চেম্বার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অবলম্বনে তৈরি এই নাটকটি ছিল আত্মার অনুসন্ধানের রূপক।
- ইম্ফল ইম্ফল – স্থানীয় প্রেক্ষাপটে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা উপস্থাপন করে।
राष्ट्रीय এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
রতন থিয়াম ১৯৮৭ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (NSD)-এর সভাপতিও ছিলেন। এই সময়ে তিনি থিয়েটার শিক্ষায় অনেক বিপ্লবী পরিবর্তন আনেন এবং তরুণ নাট্যকর্মীদের নতুন দিশা দেন। তাঁকে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী (1989) এবং অন্যান্য অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁর উপস্থাপনা জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকার মতো দেশেও প্রশংসিত হয়েছে।
রতন থিয়ামের প্রয়াণ কেবল একজন ব্যক্তির প্রস্থান নয়, এটি ভারতীয় মঞ্চের আত্মার একটি স্তম্ভের পতন। তাঁর নাটকগুলি ভারতীয় আত্মবোধকে বিশ্বের মঞ্চে তুলে ধরেছে, যা আগামী দিনের নাট্যকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাঁর শিল্প, দৃষ্টি এবং আত্মত্যাগ আগামী প্রজন্ম মনে রাখবে এবং ভারতীয় থিয়েটার তাঁর উত্তরাধিকার থেকে मार्गदर्शन নিতে থাকবে।