শ্রাবণ মাস হিন্দুধর্মে আস্থা, তপস্যা এবং সংযমের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মাস ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এবং ভক্তগণ এই পুরো মাসজুড়ে ব্রত, পূজা ও জপ-তপের মাধ্যমে শিবের প্রতি ভক্তি নিবেদন করেন। তবে শ্রাবণের গুরুত্ব কেবল ধর্মীয় নয়, বরং এতে আমাদের খাদ্য এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত অনেক ঐতিহ্যও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ঐতিহ্যগুলির পিছনে গভীর বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক কারণও লুকিয়ে থাকে।
প্রতি বছরের মতো, শ্রাবণ ২০২৫ও মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে আসবে, তবে এই মাসটি নিয়ে একটি প্রশ্ন প্রায়শই করা হয় - কেন শ্রাবণে দুধ এবং সবুজ শাকসবজি খাওয়া নিষেধ? এটি কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, এর পিছনে অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।
বৃষ্টির মরসুম এবং দুধের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন
শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি তার চরম সীমায় থাকে। চারিদিকে আর্দ্রতার পরিবেশ তৈরি হয় এবং এমন আবহাওয়ায় জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বিস্তার দ্রুত হয়। গরু ও মহিষ যে ঘাস খায়, তাও এই আর্দ্র পরিবেশে জন্মায় এবং তাতে ক্ষতিকারক জীবাণু জন্মাতে পারে। এই দূষিত ঘাস যখন পশুরা খায়, তখন তাদের দুধের বিশুদ্ধতাও প্রভাবিত হতে পারে।
এই সময়ে দুধে রোগাণু মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা শরীরে প্রবেশ করে পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। ব্রতের সময় শরীর এমনিতেই সংবেদনশীল থাকে, সেক্ষেত্রে এই ধরনের দূষিত দুধ শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত দুধ
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও শ্রাবণে দুধ সেবন না করার প্রথা জড়িত। মনে করা হয়, শ্রাবণ মাসের পুরো সময় দুধ ভগবান শিবকে উৎসর্গ করা হয়। ভক্তরা প্রতি সোমবার শিবলিঙ্গে দুধ অর্পণ করেন। এই কারণে এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, এই মাসে দুধ পান না করে তা শিবের প্রতি ভক্তি সহকারে উৎসর্গ করা উচিত।
এই প্রথা হাজার বছর ধরে চলে আসছে এবং আজও বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চল এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলিতে এটি পালন করা হয়।
শাক-সবজিতে কীট ও সংক্রমণের ঝুঁকি
সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, সর্ষের শাক, বেথুয়া, মেথি, ধনে পাতা, পুদিনা ইত্যাদি বর্ষাকালে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই সময়ে বৃষ্টির কারণে মাটিতে আর্দ্রতা অনেক বেশি থাকে। এমতাবস্থায় মাটির নিচে থাকা কীট, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক এই পাতাগুলিতে লেগে থাকে। অনেক সময় এই কীটগুলি দেখা যায় না, তবে শরীরে প্রবেশ করে পেটের রোগের কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মৌসুমে শরীরের পরিপাক ক্ষমতাও দুর্বল থাকে। এমতাবস্থায় শাকের মতো ভারী এবং দ্রুত পচনশীল জিনিস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
বাত বাড়ানো উপাদান থেকে বিরত থাকা জরুরি
আয়ুর্বেদ অনুসারে, সবুজ শাকসবজি বাত দোষ বৃদ্ধি করে। বর্ষাকালে শরীরে বাত আগে থেকেই ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে। যদি এই সময়ে এমন খাদ্য গ্রহণ করা হয় যা বাতকে আরও বাড়িয়ে তোলে, তবে পেট ফাঁপা, বদহজম, জয়েন্টে ব্যথা এবং ত্বকের সমস্যা হতে পারে।
এই কারণে আয়ুর্বেদেও বর্ষাকালে শাক খাওয়ার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এবং এর পরিবর্তে লাউ, কুমড়ো, পটল-এর মতো হালকা সবজি খাবারের তালিকায় যোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এই সবজিগুলো শ্রাবণে খাওয়া উচিত নয়
বিশেষজ্ঞ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শ্রাবণ মাসে কিছু বিশেষ সবজি বর্জন করা উচিত। এদের মধ্যে রয়েছে:
- সবুজ পেঁয়াজ
- সর্ষের শাক
- ব্রোকলি
- জলজ কলমি
- ক্যাসনি
- বাঁধাকপি
- সোঁফের পাতা
- বেথুয়া
- পুদিনা
- ধনে পাতা
- মেথি
- মুলোর পাতা
- সবুজ কলার্ড
- লেটুস পাতা
এই সবজিগুলির বৈশিষ্ট্য হল যে তারা আর্দ্রতায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে জীবাণু দ্রুত জন্মায়।
সংযম ও শুদ্ধতার প্রতীক শ্রাবণ মাস
শ্রাবণ মাস কেবল ভগবান শিবের ভক্তির সময় নয়, এটি আত্ম-সংযম, স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্থিতিশীলতার অনুশীলন করারও সুযোগ। এই সময়ে খাদ্যাভ্যাসে সাদাসিধে জীবন যাপন, মন ও শরীরকে হালকা রাখা এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া ভারতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ।
এই মাসে উপবাস পালনকারীর সংখ্যা বেশি থাকে এবং তারা ফল বা হালকা খাবার গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় দুধ এবং শাকের মতো ভারী এবং সম্ভাব্য দূষিত খাবার থেকে বিরত থাকা হয়, যাতে উপবাসের ফল বজায় থাকে এবং স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত থাকে।