ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দির: যেখানে শিব ও পার্বতীর স্বর্গীয় বিবাহ হয়েছিল

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দির: যেখানে শিব ও পার্বতীর স্বর্গীয় বিবাহ হয়েছিল

ভারতের ধর্মীয় ও পৌরাণিক স্থানগুলির মধ্যে উত্তরাখণ্ডের ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দির একটি বিশেষ স্থান, যা কেবল তার আধ্যাত্মিক গুরুত্বের জন্যই পরিচিত নয়, বরং এর অনন্য কাহিনী, স্থাপত্যকলা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত। এই মন্দিরটি ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত, তবে শিব ও পার্বতীর স্বর্গীয় বিবাহ সম্পর্কিত কাহিনীর কারণে এর খ্যাতি আরও বৃদ্ধি পায়। রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ত্রিযুগিনারায়ণ গ্রামে অবস্থিত এই মন্দিরটিকে একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে আজও একটানা জ্বলতে থাকা অগ্নি 'অখণ্ড ধুনী' রূপে তার শিখা বজায় রেখেছে।

ত্রিযুগিনারায়ণের নাম এবং এর পৌরাণিক মাহাত্ম্য

'ত্রিযুগিনারায়ণ' নামের মধ্যেই এই স্থানের আধ্যাত্মিকতা লুকিয়ে আছে। এই নামটি তিনটি শব্দ থেকে গঠিত—'ত্রি' যার অর্থ তিন, 'যুগী' যা যুগকে বোঝায়, এবং 'নারায়ণ' যা ভগবান বিষ্ণুর একটি নাম। কথিত আছে যে এখানকার অগ্নি তিনটি যুগ—সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, এবং দ্বাপর যুগ—থেকে জ্বলছে। এই কারণে এটিকে 'ত্রিযুগিনারায়ণ' বলা হয়। হিন্দু ধর্ম অনুসারে চারটি যুগ রয়েছে: সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। প্রতিটি যুগের দৈর্ঘ্য লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিমাপ করা হয়। এই মন্দিরটি এই দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানকার অগ্নি প্রতিটি যুগের সাক্ষ্য বহন করে। এই অগ্নির ভস্মকেও ভক্তরা অত্যন্ত পবিত্র মনে করেন, বিশেষ করে বৈবাহিক সুখের জন্য।

শিব-পার্বতীর স্বর্গীয় বিবাহ: ত্রিযুগিনারায়ণের কাহিনী

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দিরের সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনীটি শিব ও পার্বতীর বিবাহ সম্পর্কিত। পার্বতী, যিনি হিমালয়ের রাজা হিমবতের কন্যা ছিলেন, শিবের প্রথম স্ত্রী সতী-র পুনর্জন্ম ছিলেন। যখন সতী তাঁর পিতার অপমানের কারণে আত্মহত্যা করেন, তখন শিবের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত ছিল। পার্বতী তাঁর সৌন্দর্য এবং তপস্যার মাধ্যমে শিবের মন জয় করার চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি গৌরী কুণ্ডে কঠোর তপস্যা করেন, যা আজও ত্রিযুগিনারায়ণ থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শিব পার্বতীকে গুপ্তকাশীতে বিবাহের প্রস্তাব দেন। পরে তাদের বিবাহ ত্রিযুগিনারায়ণে অনুষ্ঠিত হয়। এই বিবাহে ভগবান বিষ্ণু কন্যাদান করেন এবং ব্রহ্মা যজমানের ভূমিকা পালন করেন। সেই সময়ের সমস্ত ঋষি এই বিবাহের সাক্ষী ছিলেন। মন্দিরের সামনে অবস্থিত 'ব্রহ্ম শিলা' নামক পাথরটি এই বিবাহস্থলকে চিহ্নিত করে।

অখণ্ড ধুনী: শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্বলতে থাকা এক শিখা

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দিরের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল এখানকার 'অখণ্ড ধুনী'। এই অগ্নি, যা শিব-পার্বতীর বিবাহের সময় থেকে জ্বলছে বলে মনে করা হয়, আজও মন্দিরের যজ্ঞ কুণ্ডে জ্বলতে থাকে। কথিত আছে যে প্রাচীনকালে এই অগ্নি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রজ্বলিত হত, কিন্তু কলিযুগে কেদার ঘাটির জমলোকি ব্রাহ্মণরা এটিকে ক্রমাগত জ্বালিয়ে রেখেছেন। জমলোকি ব্রাহ্মণরাই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এবং উপাসক। এই অগ্নি কেবল ধর্মীয় প্রতীকই নয়, বরং এটি ভক্তদের জন্য অলৌকিক বিশ্বাসের কেন্দ্রও। ভক্তরা এই জ্যোতিতে সমিধা অর্পণ করেন এবং ভস্মকে পবিত্র মনে করে নিজের সাথে নিয়ে যান। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে এই ভস্ম থেকে বৈবাহিক সুখ, সন্তান সুখ এবং সুখ-সমৃদ্ধি লাভ হয়।

চারটি পবিত্র কুণ্ড এবং জলধারা: প্রকৃতির দিব্যতা

মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে একটি জলধারা নির্গত হয়েছে, যাকে সরস্বতী গঙ্গা বলা হয়। এই জলধারা চারটি পবিত্র কুণ্ড—রুদ্র কুণ্ড, বিষ্ণু কুণ্ড, ব্রহ্মা কুণ্ড এবং সরস্বতী কুণ্ড—কে জল সরবরাহ করে।

এই কুণ্ডগুলির ধর্মীয় গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন:

  • রুদ্র কুণ্ড: শিবের সাথে যুক্ত স্নানের স্থান
  • বিষ্ণু কুণ্ড: পবিত্র জল দিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য
  • ব্রহ্মা কুণ্ড: পানীয় জলের জন্য
  • সরস্বতী কুণ্ড: পূজা অর্পণের জন্য

এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে বিবাহের আগে দেবতারা এই কুণ্ডগুলিতে স্নান করেছিলেন। সরস্বতী কুণ্ড থেকে নির্গত জল বিষ্ণুর নাভি থেকে উৎপন্ন বলে মনে করা হয়। এই কুণ্ডগুলির জলে স্নান করলে শরীর ও মন উভয়ই শুদ্ধ হয়।

স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য: মন্দিরের বিশিষ্টতা

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দিরের স্থাপত্যকলা অনেকটা কেদারনাথ মন্দিরের শৈলীর সাথে মেলে। এটি আদি শঙ্করাচার্য নির্মাণ করেছিলেন, যাঁর উত্তরাখণ্ডে অনেক মন্দির নির্মাণের কৃতিত্ব রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে ভগবান বিষ্ণুর প্রায় দুই ফুট উঁচু রূপার মূর্তি স্থাপিত আছে, যার সাথে ধনের দেবী লক্ষ্মী এবং সঙ্গীত ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীরও মূর্তি রয়েছে। এই সামগ্রিক সংমিশ্রণ এই মন্দিরটিকে একটি অত্যন্ত ধর্মীয় এবং শৈল্পিক কেন্দ্রে পরিণত করে। মন্দির চত্বরে ব্রহ্ম শিলা নামক পাথরটিকে বিবাহস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানকার ‘অখণ্ড জ্যোতি’-র চারপাশে ভক্তরা ক্রমাগত সমিধা নিবেদন করেন। এই অগ্নির সাথে জড়িত বিশ্বাস পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভূগোল এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দিরের ভৌগোলিক অবস্থানও এর মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করে। এই মন্দিরটি মন্দাকিনী এবং সোনগঙ্গা নদীর संगम থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে 1980 মিটার (প্রায় 6500 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত মনোরম, যেখানে ঠান্ডা জলবায়ু, বরফে ঢাকা পাহাড় এবং আপেল এবং অন্যান্য ফল গাছের বাগান রয়েছে। তিন মাসের শীতকালে এখানে বরফের পুরু চাদর পড়ে। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যাত্রী এবং ভক্তদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে।

পৌঁছানোর উপায় ও যাত্রাপথ

ত্রিযুগিনারায়ণ গ্রামে পৌঁছানোর জন্য সোনপ্রয়াগ থেকে মোটরযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এছাড়াও, অনেক ট্রেকিং রুটও রয়েছে, যার মধ্যে একটি জনপ্রিয় রুট হল সোনপ্রয়াগ থেকে ৫ কিলোমিটারের ছোট ট্রেকিং, যা ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যায়। কেদারনাথ থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার, যা পাহাড়ে ট্রেকিং প্রেমীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং এবং মনোরম অভিজ্ঞতা প্রদান করে। মুসৌরি থেকে শুরু হওয়া ১৭ দিনের ট্রেকিং রুটটিও বিখ্যাত, যাতে টিहरी, বেলাক, বুড়াকেদার, ঘুট্টু, পঁওয়ালী কাঁটা, ত্রিযুগিনারায়ণ এবং অবশেষে কেদারনাথ অন্তর্ভুক্ত। উত্তরাখণ্ড সরকার এই অঞ্চলকে পর্যটক এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি সার্কিট তৈরি করেছে, যার মধ্যে রুদ্রপ্রয়াগ-केदारनाथ সার্কিট প্রধান। নিকটতম বিমানবন্দর হল দেরাদুন, যা প্রায় ২৪৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দির কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জনজীবনেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে প্রতি বছর অসংখ্য তীর্থযাত্রী আসেন, যারা বিশেষ করে বৈবাহিক সুখ, সন্তান সুখ এবং পারিবারিক সৌভাগ্যের জন্য পূজা-অর্চনা করেন। মন্দিরের কাছে অবস্থিত চারটি কুণ্ডের জল পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং এটি বন্ধ্যাত্ব দূর করতে সহায়ক বলেও কথিত। এই স্থানটি একদিকে যেমন বিশ্বাসের কেন্দ্র, তেমনই সামাজিক সম্প্রীতিরও প্রতীক। জমলোকি ব্রাহ্মণরা যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মন্দিরের সেবা করে আসছেন, তাঁদের সংস্কৃতিও এই মন্দিরের সাথে জড়িত।

ত্রিযুগিনারায়ণে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা

এই মন্দিরে আসা ভক্তরা কেবল ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকেন না, বরং এখানকার শান্ত পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতিও লাভ করেন। মন্দিরের পবিত্র অগ্নি, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ, নদীর বয়ে চলার মিষ্টি আওয়াজ এবং ঠান্ডা বাতাস মনকে শান্তি ও আনন্দে ভরে তোলে। এখানকার যাত্রা কেবল মন্দির দর্শনই নয়, বরং একটি আত্মিক সফর, যা ভক্তকে নিজের মধ্যে তাকাতে এবং আধ্যাত্মিকতার গভীর অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করে।

ত্রিযুগিনারায়ণ মন্দির তার অনন্য অগ্নি, স্বর্গীয় শিব-পার্বতী বিবাহের কাহিনী এবং পবিত্র কুণ্ডগুলির কারণে একটি अद्भुत तीर्थस्थल। এই মন্দির কেবল আস্থার কেন্দ্র নয়, বরং আধ্যাত্মিক শান্তি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য संगम উপস্থাপন করে। এখানকার যাত্রা জীবনে নতুন শক্তি ও শ্রদ্ধার সঞ্চার করে।

Leave a comment