মার্কিন শুল্কে টালমাটাল বঙ্গের চিংড়ি রপ্তানি টান পড়ছে লক্ষ মানুষের জীবনে

মার্কিন শুল্কে টালমাটাল বঙ্গের চিংড়ি রপ্তানি টান পড়ছে লক্ষ মানুষের জীবনে

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের চাপানো ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক এখন বাংলার চিংড়ি রপ্তানি শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করলেও, এবার সেই দরজা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে।মার্কিন শুল্কের ফলে বাংলার চিংড়ি শিল্পে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অস্থিরতা।

বাংলার গর্ব চিংড়ি এখন ‘অতিরিক্ত দামি’

বাংলা থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকার সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানি হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকে চিংড়ি। প্রায় ৭৫–৮০ শতাংশ পণ্য মার্কিন বাজারমুখী। কিন্তু নতুন শুল্ক আর পুরনো অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি মিলে আমেরিকায় এখন চিংড়ির উপরে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর চাপছে। ফলে বাংলার ভ্যানামেই, বাগদা বা গলদা চিংড়ি মার্কিন বাজারে অতিমূল্যবান হয়ে পড়েছে।মার্কিন শুল্কে বাংলার চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে।

কোন কোন জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি

রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয়। এই তিন জেলা মিলিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মাছচাষিদের কথায়, শুধু শুল্ক বৃদ্ধিই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আগের নিয়মের চাপও বাড়তি বোঝা তৈরি করেছে। প্রায় ৪০টি রপ্তানি সংস্থা, পাশাপাশি গ্রামীণ স্তরে যুক্ত ক্ষুদ্র চাষিরা এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।২৪ পরগনা ও মেদিনীপুরে হাজার হাজার চাষি ও শ্রমিক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

রপ্তানির ভরসা ছিল আমেরিকা

বাংলায় বছরে প্রায় ৭০,০০০ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশই রপ্তানি হয় বিদেশে। এর মধ্যে আবার বড় অংশ যায় আমেরিকায়। দামি ভ্যানামেই চিংড়ি থেকে শুরু করে বাগদা, গলদা—সব কিছুরই মার্কিন বাজারে ছিল বিশেষ কদর। এবার সেই বাজার কার্যত বন্ধ হওয়ার মুখে।আমেরিকার বাজার হারালে বাংলার চিংড়ি রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামবে।

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া

বাংলার রপ্তানিকারীরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক কম দেশগুলির সামনে ভারত কার্যত দাঁড়াতেই পারছে না। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ইকুয়েডর—সব দেশের চিংড়িই আমেরিকায় সহজলভ্য ও তুলনায় অনেক সস্তা। ফলে আন্তর্জাতিক দরপত্রে ভারতীয় রপ্তানিকারীরা ধাক্কা খাচ্ছেন বারবার।কম শুল্কের কারণে অন্য দেশগুলির চিংড়ি সহজেই দখল করছে মার্কিন বাজার।

বিকল্প বাজার কি ভরসা দিতে পারবে?

রপ্তানিকারীরা এখন চোখ রাখছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকও সেই দিকেই এগোতে পরামর্শ দিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের মতে, নতুন বাজারে জায়গা করে নেওয়া সহজ নয়। ইউরোপে প্রতিযোগিতা ভয়ঙ্কর, চিনে আবার আর্থিক লেনদেনের নিয়ম জটিল। অন্যদিকে, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে জাপান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় চাহিদা মেটাতে পারবে না।বিকল্প বাজারে রপ্তানির চেষ্টা শুরু হলেও বাস্তবে তা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের।

সরকারি সহায়তার দাবি

বাংলার শিল্পমহল মনে করছে, শুধু কেন্দ্র নয়, রাজ্যকেও এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি চিংড়ি চাষিদের বাঁচাতে জরুরি আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া প্রয়োজন। নাহলে একদিকে যেমন রপ্তানির বাজার ভেঙে পড়বে, অন্যদিকে লক্ষ মানুষের জীবিকা ধ্বংসের মুখে পড়বে।রপ্তানিকারীরা কেন্দ্র ও রাজ্যের কাছে জরুরি আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন।

আশঙ্কার মেঘ আরও ঘনাচ্ছে

বিশেষজ্ঞ সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের পূর্বাভাস আরও চিন্তার। তাদের মতে, মার্কিন শুল্কের কারণে ভারতের সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। অর্থাৎ, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের সামুদ্রিক রপ্তানি খাতই ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্কের ধাক্কায় ভারতের রপ্তানি ভয়ঙ্করভাবে কমে যেতে পারে।

উপসংহার

চিংড়ি শুধু বাংলার অন্যতম রপ্তানি শিল্পই নয়, হাজার হাজার মৎস্যজীবী ও শ্রমিক পরিবারের প্রধান ভরসাও। মার্কিন শুল্কের কাঁটা সেই জীবন-জীবিকাকেই টালমাটাল করে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন একটাই—সরকার ও শিল্প একসঙ্গে কি কোনও বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে পারবে? নাকি বাংলার অন্যতম প্রধান রপ্তানি ক্ষেত্র অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগোবে?শুল্কের ধাক্কায় প্রশ্নের মুখে বাংলার চিংড়ি শিল্পের ভবিষ্যৎ।

 

Leave a comment