২০২৫ সালের ভারত বনধে ২৫ কোটির বেশি শ্রমিক সরকারের শ্রম নীতির প্রতিবাদে ধর্মঘট করেন, যার ফলে ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ, বীমা এবং পরিবহন পরিষেবা ব্যাহত হয়।
২০২৫ সালের ভারত বনধ: আজ দেশজুড়ে 'ভারত বনধ'-এর প্রতিধ্বনি শোনা গেল, যখন কোটি কোটি শ্রমিক, কৃষক এবং গ্রামীণ মজদুর একজোট হয়ে রাস্তায় নামেন। কেন্দ্র সরকারের শ্রম ও কৃষি নীতির বিরুদ্ধে আয়োজিত এই ধর্মঘট, সাম্প্রতিক বছরগুলির মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক শিল্প ধর্মঘটগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় দেশের ১০টি প্রধান কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, যেখানে ব্যাঙ্ক, ডাক, বীমা, কয়লা খনি, বিদ্যুৎ, নির্মাণ এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের শ্রমিকরা অংশ নিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছে, এই ঐতিহাসিক বনধে প্রায় ২৫ কোটি শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল।
ব্যাংকিং পরিষেবা ব্যাহত, নগদ তোলার সংকট
২০২৫ সালের ভারত বনধের অধীনে ব্যাঙ্ক কর্মীরা ধর্মঘটে অংশ নেন, যার ফলে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাংকিং পরিষেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং ঝাড়খণ্ডের মতো অঞ্চলে ব্যাংক শাখাগুলি বন্ধ ছিল এবং এটিএমগুলিতে নগদ টাকার চরম অভাব দেখা যায়। এর ফলে সাধারণ মানুষকে টাকা তোলা, জমা করা এবং অন্যান্য ব্যাংকিং কাজকর্ম করতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
বিদ্যুৎ পরিষেবাগুলিতে বড় প্রভাব, অনেক জায়গায় ব্ল্যাকআউটের পরিস্থিতি
২০২৫ সালের ভারত বনধের সময় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রায় ২৭ লক্ষ কর্মচারী ধর্মঘটে যোগ দেওয়ায় অনেক জায়গায় বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং শিল্পাঞ্চলে এর গুরুতর প্রভাব পড়ে। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের মতো রাজ্যগুলির অনেক অঞ্চলে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল, যার ফলে সাধারণ মানুষ এবং বাণিজ্যিক কাজকর্ম উভয়ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়।
রেল পরিষেবা চালু, তবে বিলম্ব এবং বিশৃঙ্খলা
২০২৫ সালের ভারত বনধের সময় রেল পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়নি, তবে ধর্মঘটের কারণে অনেক ট্রেনের চলাচলে বিলম্ব দেখা যায়। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা রেল লাইনে বসে বিক্ষোভ দেখান এবং প্রতিবাদ জানান, যার ফলে ট্রেনগুলি থামিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে হাওড়া, মুম্বাই এবং ভুবনেশ্বরের মতো বড় রেলওয়ে স্টেশনগুলিতে যাত্রীদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয় এবং তাদের ভ্রমণে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
বীমা এবং ডাক বিভাগে কাজও বন্ধ
এলআইসি এবং অন্যান্য বীমা কোম্পানির কর্মীরা ধর্মঘটে অংশ নিয়ে সরকারের বেসরকারিকরণ নীতির বিরোধিতা করেন। এর ফলে বীমা দাবি এবং অন্যান্য পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও, ডাক বিভাগের কর্মীদের অংশগ্রহণের কারণে চিঠি এবং পার্সেল বিতরণে বিলম্ব হয়। অনেক শহরে মানুষজন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং জিনিসপত্র সময় মতো পাননি, যার ফলে সাধারণ মানুষকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
কৃষক ও গ্রামীণ শ্রমিকদেরও সমর্থন
শুধু শ্রমিকরাই নয়, কৃষক ও গ্রামীণ শ্রমিকদেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি)-এর সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কৌর জানান, অনেক কৃষক সংগঠন এই ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিল। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে কৃষকরা রাস্তায় নেমে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন এবং তাদের ঐক্য ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এর ফলে আন্দোলনে আরও শক্তি যোগ হয়।
স্কুল-কলেজ খোলা ছিল, তবে উপস্থিতি কম ছিল
সরকার স্কুল ও কলেজগুলির জন্য কোনও ছুটি ঘোষণা করেনি, তাই সেগুলি খোলা ছিল। কিন্তু অনেক এলাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সমস্যা হওয়ায় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা সময়মতো পৌঁছতে পারেননি। বিশেষ করে ছোট শহর ও গ্রামগুলিতে উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়, যার ফলে শ্রেণীকক্ষগুলির কার্যক্রম ঠিকমতো চালানো যায়নি এবং পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মনরেগা-য় সংস্কার এবং কর্মসংস্থানের দাবি
শ্রমিক সংগঠনগুলি মনরেগা প্রকল্পে সংস্কারের জোরালো দাবি জানায়। তারা বলেছিল যে কাজের দিনের সংখ্যা বাড়ানো হোক এবং মজুরি হারও বাড়ানো হোক, কারণ গ্রামীণ অঞ্চলে বেকারত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, সরকারের প্রকল্পগুলি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ, এবং তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, যার ফলে দরিদ্র পরিবারগুলির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
সরকারের চারটি নতুন শ্রম আইন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু
২০২৫ সালের ভারত বনধের পিছনে একটি বড় কারণ হল সরকার কর্তৃক আরোপিত চারটি নতুন শ্রম আইন, যেগুলিকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের প্রতিকূলে মনে করে। তাদের মতে, এই আইনগুলির মাধ্যমে কাজের সময় বাড়ানো হয়েছে, যা শ্রমিকদের উপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও, তাদের এখন সম্মিলিতভাবে নিজেদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলার অধিকারও দেওয়া হচ্ছে না। ইউনিয়নগুলির আরও বক্তব্য, এই আইনগুলি নিয়োগকর্তাদের দায়বদ্ধতা কমিয়েছে, যার ফলে শ্রমিকদের শোষণের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে।
'ব্যবসার স্বাচ্ছন্দ্য'-এর নামে শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে
ট্রেড ইউনিয়নগুলি সরকারের উপর অভিযোগ করেছে যে তারা 'ইজ অফ ডুইং বিজনেস' অর্থাৎ ব্যবসা সহজ করার নামে কেবল বড় শিল্পপতিদের সুবিধা দেখছে। তাদের বক্তব্য, এই নীতিগুলির কারণে শ্রমিক এবং কৃষকদের অধিকারের অবজ্ঞা করা হচ্ছে। নতুন নিয়মগুলি শ্রমিকদের দুর্বল করে দিয়েছে এবং তাদের নিরাপত্তা বা ন্যায়বিচার দেওয়া হচ্ছে না। এই ধর্মঘটটি এই অসাম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে একটি গণ-আন্দোলন হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের আওয়াজ তুলেছেন।
সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি – দাবি মানতে হবে, না হলে সংগ্রাম আরও তীব্র হবে
ট্রেড ইউনিয়নগুলি স্পষ্টভাবে সরকারকে সতর্ক করেছে যে, যদি তাদের দাবিগুলি দ্রুত পূরণ না করা হয়, তবে এই আন্দোলন আরও বড় রূপ নিতে পারে। ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, তারা এখন সংসদ অধিবেশনের সময় দেশব্যাপী বৃহত্তর পর্যায়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পরিকল্পনা করছে। তাদের উদ্দেশ্য হল, সরকার যেন শ্রমিক ও কৃষকদের আওয়াজকে উপেক্ষা না করে, অন্যথায় সংগ্রাম আরও তীব্র করা হবে। এই ধর্মঘট একটি সতর্কবার্তা, এটি শেষ নয়।