অনিল আগরওয়ালের নেতৃত্বাধীন বেদান্ত গ্রুপকে ঘিরে আবারও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আমেরিকার বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা ভাইসরয় রিসার্চ বেদান্ত রিসোর্সেস লিমিটেড (VRL) এবং তার ভারতীয় ইউনিট বেদান্ত লিমিটেড (VEDL)-এর বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে।
ভাইসরয় রিসার্চের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, বেদান্ত লিমিটেড তার মূল সংস্থা বেদান্ত রিসোর্সেসকে ব্র্যান্ড ফি-এর নামে ১,০৩০ কোটি টাকা হস্তান্তর করেছে এবং পরে এই অর্থ ফেরত (রিবেট) হিসাবে দেখানো হয়েছে।
ইডি-র তদন্ত এবং কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ
ভাইসরয় রিসার্চ আরও দাবি করেছে যে, জুলাই ২০২৩-এ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) বেদান্ত লিমিটেডের তৎকালীন মুখ্য ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) সোনালী শ্রীবাস্তবকে এই ব্র্যান্ড ফি হস্তান্তর নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
রিপোর্ট অনুযায়ী, সোনালী শ্রীবাস্তব তদন্তে সহযোগিতা করেছিলেন, যেখানে কোম্পানির সিইও সুনীল দুগ্গল ইডি-র সামনে হাজির হননি। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, শ্রীবাস্তব ঘটনার পাঁচ মাস পরে পদত্যাগ করেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী ফিনান্সিয়াল ডকুমেন্টস-এ স্বচ্ছতার অভাব
ভাইসরয় রিসার্চের বক্তব্য, এই সম্পূর্ণ তহবিল হস্তান্তরের তথ্য বাজারকে জানানো হয়নি, এমনকি কোম্পানির বন্ডহোল্ডারদেরও জানানো হয়নি। কোম্পানিটি তাদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রিপোর্টে এই অর্থের কোনও স্পষ্ট বিবরণ দেয়নি, যা স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, এই লেনদেনের প্রক্রিয়া কর্পোরেট গভর্নেন্সের মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না এবং এটি বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন (ফেমা)-এর নিয়ম লঙ্ঘন করে।
বিনা সুদের 'ক্রেডিট লাইন'-এর মতো ব্যবহার
ভাইসরয়ের আরও অভিযোগ, ব্র্যান্ড ফি-কে এক ধরনের সুদবিহীন 'ক্রেডিট লাইন' হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, যখন বেদান্ত রিসোর্সেসের অর্থের প্রয়োজন হতো, তখন বেদান্ত লিমিটেড এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলো ব্র্যান্ড ফির নামে অর্থ পাঠাতো।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেদান্ত লিমিটেড এবং এর সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ভিআরএল-কে প্রায় ৩,০৮৫ কোটি টাকার ব্র্যান্ড ফি দিয়েছে। এটি বেদান্ত লিমিটেডের মোট আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ।
ভাইসরয়ের অভিযোগ, এই পরিমাণ অর্থ মূল কোম্পানির মোট ৪.৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং বার্ষিক ৮৩৫ মিলিয়ন ডলারের সুদ পরিশোধ করতে কাজে লেগেছে।
আগেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে
ভাইসরয় রিসার্চের পক্ষ থেকে এটি প্রথম আক্রমণ নয়। ৯ জুলাই প্রকাশিত ৮৭ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে ভাইসরয় বেদান্ত রিসোর্সেসকে "পরজীবী কোম্পানি" হিসেবে অভিহিত করেছিল। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, বেদান্ত রিসোর্সেস তার সহযোগী সংস্থাগুলোর সম্পদ ভুলভাবে ব্যবহার করছে, যাতে তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারে।
রিপোর্টে আরও অভিযোগ করা হয়েছিল যে, কোম্পানির ব্যালেন্স শীটে বিশাল গরমিল রয়েছে এবং সম্পত্তিকে ভুলভাবে দেখানো হয়েছে।
বেদান্তের পাল্টা জবাব, বলল- বিদ্বেষপূর্ণ রিপোর্ট
বেদান্ত এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে যে, ভাইসরয় রিসার্চের রিপোর্টটি সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য এবং মনগড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কোম্পানির অভিযোগ, এই রিপোর্টটি তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।
বেদান্তের বক্তব্য, রিপোর্ট প্রকাশের আগে ভাইসরয় কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এবং কোনও ব্যাখ্যাও চায়নি। বেদান্ত স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, তাদের সমস্ত আর্থিক লেনদেন নিয়ম ও পদ্ধতি মেনেই হয়।
ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির উল্লেখও রয়েছে রিপোর্টে
ভাইসরয় রিসার্চের করা অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে এই বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপোর্টে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ভাইসরয়ের রিপোর্টকে অবিশ্বাস্য বলেছিলেন। যদিও এর প্রেক্ষাপট এবং ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা হয়নি।
আর্থিক লেনদেন এবং কর্পোরেট নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন
এই পুরো ঘটনাটি কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোর পরিচালনা নিয়ে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যখন একটি বড় এবং স্বনামধন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তের মতো অভিযোগ ওঠে, তখন বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রভাবিত হয়।