ভারতের ইতিহাসে এমন অনেক বীর যোদ্ধা হয়েছেন যাদের জীবনের কাহিনী লোককথায় বেঁচে আছে এবং যাদের বীরত্ব কেবল সীমান্তের সুরক্ষাই করেনি, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও বাঁচিয়ে রেখেছে। বপ্পা রাওয়াল এমনই একজন মহান যোদ্ধা এবং প্রশাসক ছিলেন, যিনি ৮ম শতাব্দীতে মেওয়ারের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং আরব আক্রমণের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করেন। এই নিবন্ধটি বপ্পা রাওয়ালের জীবন, তাঁর সামরিক দক্ষতা, আধ্যাত্মিকতা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব গভীরভাবে তুলে ধরে।
প্রাথমিক জীবন এবং রহস্যময় উৎপত্তি
বপ্পা রাওয়ালের জন্ম গুহিল বংশের নাগাদিত্যের পুত্র হিসেবে। কিন্তু তাঁর শৈশব ছিল সংগ্রামপূর্ণ। ইডারের ভিলদের আক্রমণে তাঁর বাবা সহ পরিবারের পুরুষরা নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে একজন ব্রাহ্মণ মহিলা বপ্পাকে লালন-পালন করেন এবং তাঁকে একজন গোপালক হিসেবে রাখেন। তাঁর আসল পরিচয় গোপন ছিল, কিন্তু নিয়তি তাঁকে একজন সাধারণ গোয়ালা থেকে মেওয়ারের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ঋষি হরিত রাশির সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। ঋষি তাঁকে শৈব সম্প্রদায়ে দীক্ষা দেন, যার ফলে বপ্পা কেবল একজন যোদ্ধা নন, একজন তপस्वी রাজা হিসেবেও পরিচিত হন।
আধ্যাত্মিকতা এবং একলিঙ্গজী মন্দির নির্মাণ
ঋষি হরিত রাশির নির্দেশে বপ্পা রাওয়াল তপস্যা করেন এবং আত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি নাগদায় বিখ্যাত একলিঙ্গজী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও মেওয়ারের রাজবংশের আরাধ্য স্থান। কথিত আছে, এই মন্দিরের কারণেই মেওয়ারের শাসকরা নিজেদের একলিঙ্গজীর সেবক মনে করতেন, রাজা নন। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বপ্পা রাওয়ালের উত্তরাধিকার।
মেওয়াড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা
একলিঙ্গ মহাত্ম্য অনুসারে, বপ্পা রাওয়াল ৭২৮ খ্রিস্টাব্দে মেওয়াড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মেওয়াড়কে কেবল একটি ভৌগোলিক রাজ্য হিসেবে নয়, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি ইডারের ভিলদের পরাজিত করেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের ভূমি পুনরুদ্ধার করেন। এই প্রতিষ্ঠার পেছনে শুধু তাঁর সামরিক দক্ষতা নয়, শৈব বিশ্বাস এবং সাধু-সন্তদের আশীর্বাদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরব আক্রমণ থেকে ভারতের রক্ষা
৮ম শতাব্দীতে ভারতে আরব আক্রমণ চলছিল। উমাইয়া খিলাফতের সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের পর আরবদের নজর ছিল রাজস্থান ও গুজরাটের দিকে। এই সময়ে বপ্পা রাওয়াল মৌর্য শাসক মান মৌর্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ইতিহাসবিদ আর.সি. মজুমদারের মতে, চিতোরগড় শাসন করা মৌর্য শাসকদের পরাজিত করে আরবরা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু বপ্পা রাওয়াল এবং অন্যান্য হিন্দু শাসকদের জোট আরবদের চিতোরগড় থেকে বিতাড়িত করে। এতে বপ্পা রাওয়ালের খ্যাতি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি স্বয়ং শাসক হন।
প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ভারসাম্য
বপ্পা রাওয়াল কেবল আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করেননি, বরং সেই সময়ের দুই প্রধান ভারতীয় শক্তি—প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট—এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতেও সফল হন। মনে করা হয়, তিনি প্রতিহার শাসক নাগভট্ট প্রথমকে সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রকূটদের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও যুদ্ধ করেন। এই কৌশলগত জ্ঞান এবং সামরিক চতুরতা তাঁর অনন্য নেতৃত্বকে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে তিনি মেওয়ারের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন।
বপ্পা রাওয়ালের স্বর্ণমুদ্রা ও শৈব প্রতীক
'শ্রী বোপ্পা' এবং 'শ্রী বোপ্পরাজা' খোদাই করা স্বর্ণমুদ্রা বপ্পা রাওয়ালের সঙ্গে যুক্ত। এই মুদ্রাগুলিতে শৈব প্রতীক—ত্রিশূল, নন্দী ষাঁড়, লিঙ্গ—স্পষ্টভাবে খোদাই করা আছে। এই প্রতীকগুলি বপ্পা রাওয়ালের গভীর শৈব ভক্তি এবং পাশুপত সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রকে নির্দেশ করে। একটি মুদ্রায় একটি দণ্ডবৎ মুদ্রায় পুরুষের মূর্তি দেখা যায়, যার কান ছিদ্র করা। এটি নাথ সম্প্রদায়ের দীক্ষা পদ্ধতির ইঙ্গিত হতে পারে, যা থেকে মনে করা হয় বপ্পার সম্পর্ক পরবর্তীকালে এই পন্থের সঙ্গেও ছিল।
ঐতিহাসিক পরিচয় নিয়ে মতভেদ
'বপ্পা' একটি সম্মানসূচক শব্দ এবং 'রাওয়াল' রাজকীয় উপাধি। তাই ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে যে বপ্পা রাওয়াল কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন নাকি কেবল একটি পদবি। কিছু শিলালিপিতে তাঁর নাম পাওয়া যায়, আবার কিছুতে পাওয়া যায় না। জি.এইচ. ওঝা এবং দশরথ শর্মার মতো ঐতিহাসিকরা তাঁকে 'কালভোজ'-এর সঙ্গে যুক্ত করেন, যেখানে অন্য পণ্ডিতরা 'খুমান' বা 'শিলাদিত্য'-এর সঙ্গে। যদিও এই বিতর্ক চলছে, তবে বপ্পা রাওয়ালের ঐতিহাসিক প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁর বীরত্ব এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠার উল্লেখ অনেক শিলালিপি ও গ্রন্থে পাওয়া যায়।
বপ্পা রাওয়ালের উত্তরাধিকার
বপ্পা রাওয়ালের মেওয়াড় আজও ভারতের ইতিহাসে গৌরবের প্রতীক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত একলিঙ্গজী মন্দির শুধু ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও। তাঁর কৌশলগত দক্ষতা, আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস এবং শৈব ভক্তির ঐতিহ্য মেওয়াড়কে একটি নতুন রূপ দিয়েছে। ইতিহাস তাঁকে কালভোজ বলুক বা শিলাদিত্য, তাঁর পরিচয় একজন রাষ্ট্ররক্ষক, ধর্মনিষ্ঠ এবং নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে অটল।
বপ্পা রাওয়ালের জীবন কেবল একজন যোদ্ধার গল্প নয়, একজন সন্ত, শাসক এবং দেশরক্ষকের কাহিনী। তিনি শুধু মেওয়াড় প্রতিষ্ঠা করেননি, একলিঙ্গজী মন্দিরের মতো সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলির ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন। আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ভারতের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর বীরত্ব, ভক্তি এবং দূরদর্শিতা আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।