ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮৩ বছর: কিভাবে এই আন্দোলন স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিল

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮৩ বছর: কিভাবে এই আন্দোলন স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিল

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল প্রথম ব্যাপক গণবিদ্রোহ, যা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে ভারতীয়রা আর নতি স্বীকার করবে না। আন্দোলন ব্রিটিশদের যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট এবং অস্থিরতার মধ্যে ফেলেছিল। এর ফলে তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়, যা অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।

করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে: আজ থেকে ৮৩ বছর আগে, ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট ভারতের ইতিহাসে এমন একটি দিন এসেছিল যা ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই দিনে মহাত্মা গান্ধী মুম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দান থেকে 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' (করব অথবা মরব) স্লোগান দিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এই আন্দোলন কোনও সাধারণ প্রতিবাদ ছিল না — বরং একটি ব্যাপক গণবিপ্লব ছিল, যা ব্রিটিশ সরকারকে এই উপলব্ধি করিয়েছিল যে ভারতকে আর পরাধীন রাখা সম্ভব নয়।

এই আন্দোলন ভারতীয় জনগণের মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে একটি निर्णायक মোড় এনে দেয়। আসুন, এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম এবং প্রভাবগুলি বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের প্রতি অবজ্ঞা

১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই যুদ্ধের অংশ করে নেয়। ভারতীয় নেতারা এই আচরণকে অপমানজনক মনে করেছিলেন। কংগ্রেস পার্টি ব্রিটেনকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে ভারত যদি তাদের যুদ্ধে সহায়তা করে, তবে বিনিময়ে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৪২ সালে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস মিশন ভারতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু এই মিশন শুধুমাত্র সীমিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। এটি সমস্ত ভারতীয় নেতাই সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন। এই ব্যর্থতা দেশের অসন্তোষের আগুনকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

গান্ধীজির নেতৃত্ব এবং 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' স্লোগান

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর মহাত্মা গান্ধী সিদ্ধান্ত নিলেন যে শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে না। তিনি ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট মুম্বাইতে একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় যে ঐতিহাসিক কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজও ভারতবাসীর হৃদয়ে ধ্বনিত হয়: 'ইংরেজরা ভারত ছাড়ো। আমরা হয় ভারতকে স্বাধীন করব, অথবা এই প্রচেষ্টায় প্রাণ দেব।'

এই একটি বাক্য যেন সারা দেশের শিরায় বিদ্যুৎ সঞ্চার করল।

কংগ্রেসের ঐতিহাসিক প্রস্তাব

মুম্বাইয়ের এই বৈঠকে, अखिल ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে 'ভারত ছাড়ো' প্রস্তাব পাশ করে। এটা স্থির হয় যে এখন থেকে স্বাধীনতার লড়াই পূর্ণ শক্তিতে লড়া হবে। গান্ধীজি অহিংস পথ অনুসরণের আবেদন জানান, কিন্তু জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এতটাই বেশি ছিল যে আন্দোলন অনেক জায়গায় হিংসাত্মক রূপ নেয়।

নেতাদের গ্রেপ্তার ও জনগণের বিদ্রোহ

আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সরকার প্রথমত কংগ্রেসের প্রধান নেতাদের গ্রেপ্তার করে। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ সহ শত শত নেতাকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু এর ফলস্বরূপ সারাদেশের মানুষ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

রেলওয়ে স্টেশন জ্বালানো হয়, ডাকঘর তছনছ করা হয় এবং সরকারি ভবনে হামলা চালানো হয়। অনেক জায়গায় মানুষজন স্বাধীন সরকারও প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর প্রদেশের বালিয়া, পশ্চিমবঙ্গের তমলুক এবং মহারাষ্ট্রের সাতারাতে 'আজাদ প্রশাসন' প্রতিষ্ঠিত হয়।

ছাত্র, মহিলা এবং ভূমিগত আন্দোলনের ভূমিকা

আন্দোলন যত গভীর হতে থাকে, ভূমিগত কার্যকলাপও তত বাড়তে থাকে। জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলী, রাম মনোহর লোহিয়া এবং ঊষা মেহতার মতো বিপ্লবী নেতারা কোনও রকম আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলনকে নতুন পথে চালিত করেন।

  • অরুণা আসফ আলী গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের অনুপস্থিতিতে মুম্বাইয়ে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।
  • ঊষা মেহতা একটি গোপন রেডিও স্টেশন চালিয়ে আন্দোলনের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • মহিলারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লিফলেট বিলি করতেন, আহত আন্দোলনকারীদের সেবা করতেন এবং ব্রিটিশ পুলিশের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ জানাতেন।
  • ছাত্র সংগঠন, যুবকর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

ব্রিটিশ শাসনের টলমল ভিত্তি

'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' ব্রিটিশ শাসনের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল। যদিও এই আন্দোলনকে সামরিক শক্তি দিয়ে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ, হাজার হাজার মানুষের গ্রেপ্তার এবং শত শত মানুষের আত্মত্যাগ প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ভারতকে আর থামানো যাবে না।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ভারতীয় রেল, টেলিগ্রাফ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতির কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের মিত্রশক্তি — যেমন আমেরিকা — ও ব্রিটেনের ওপর ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

স্বাধীনতার দিকে निर्णायक পদক্ষেপ

যদিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর ভারত তৎক্ষণাৎ স্বাধীনতা পায়নি, তবে এটি স্বাধীনতার গণনা শুরু করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে ভারতে শাসন করা আর সম্ভব নয়।

আন্দোলনের পর কংগ্রেসের কার্যকলাপ কিছুটা কমে গেলেও, জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কখনও দুর্বল হয়নি। এই কারণেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটেনকে ভারত স্বাধীন করতে বাধ্য হতে হয়। অবশেষে, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতার সূর্য দেখতে পায়।

Leave a comment