ঐতিহ্য আর আয়ুর্বেদের মিশেল ভূত চতুর্দশীর রীতি:ভূত চতুর্দশী মানেই আলো আর আচার— ১৪ বাতি জ্বালানো ও ১৪ শাক খাওয়ার দিন। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয় এই বিশেষ পার্বণ, যাকে নরক চতুর্দশীও বলা হয়। বিশ্বাস, ১৪ শাক খেলে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে শরীর পায় বাড়তি প্রতিরোধ ক্ষমতা, আর ১৪ বাতি প্রজ্বলনে সম্মান জানানো হয় পূর্বপুরুষদের।

কেন খাওয়া হয় ১৪ শাক
নব্য স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দনের মতে, ১৪ শাক খাওয়া একাধারে ধর্মীয় আচার এবং শারীরিক স্বাস্থ্যরক্ষার উপায়। বাংলা পঞ্জিকায়ও এই শাকগুলির নাম উল্লেখ আছে। একসঙ্গে তিতকুটে স্বাদের ১৪ প্রকার শাক খেলে শরীর থেকে বিষদোষ দূর হয় এবং হজম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়— এমনটাই বলে আয়ুর্বেদ।

ভূত চতুর্দশীর ১৪ শাকের নাম ও উপকারিতা
ওলশাক — সর্দি-কাশি ও ঠান্ডা লাগা থেকে রক্ষা করে, হজমে সাহায্য করে।
কেঁউশাক — কৃমি, চর্মরোগ ও ত্বকের লাবণ্য বৃদ্ধিতে কার্যকর।
বেতোশাক — লিভার সুস্থ রাখে, অখিদে ও পাইলস উপশমে সাহায্য করে।

সরষে শাক — গুড কোলেস্টেরল বাড়ায়, ভিটামিন ডি উৎপাদনে সাহায্য করে।
কালকাসুন্দে শাক — সর্দিকাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য ও অ্যালার্জিতে উপকারী।
নিমপাতা — রক্তশোধক, ডায়াবেটিস ও কৃমির সমস্যা দূর করে।

জয়ন্তী পাতা — সর্দি, নাক বন্ধ ও মাথাব্যথা কমাতে সহায়ক।
সাঞ্চি শাক (মালঞ্চ) — রক্তে কোলেস্টেরল কমায়, হজমে সাহায্য করে।
হিলঞ্চ শাক (হিঞ্চে) — রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়, পিত্তের সমস্যা দূর করে।
পলতাপাতা (পটলের পাতা) — হজমশক্তি বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়।
শৌলফ পাতা — ক্ষত, জ্বর ও মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধিতে উপকারী।
গুলঞ্চ শাক — জন্ডিস, গেঁটে বাত ও ডায়াবেটিসে উপকার দেয়।
ভাটপাতা — হাঁপানি, সর্দি ও চুল পড়া রোধে উপকারী।
শুষনি শাক — মানসিক চাপ কমায়, উচ্চ রক্তচাপ ও মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণ করে।

আয়ুর্বেদ বলছে কেন জরুরি এই শাকগুলি
তিতকুটে স্বাদের শাক শরীরের অন্তর্গত বিষদ্রব্য দূর করে। শরীরকে হালকা রাখে ও রক্ত পরিষ্কার করে। আয়ুর্বেদ মতে, শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় এই শাক খেলে ঠান্ডা-কাশি, সর্দি, জ্বরের মতো মৌসুমি রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

১৪ বাতি প্রজ্বলনের অর্থ
ভূত চতুর্দশীর আরেকটি রীতি হলো ১৪টি দীপ জ্বালানো। বিশ্বাস, এটি পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সম্মান জানানোর এক উপায় এবং ঘর থেকে অশুভ শক্তি দূর রাখার প্রতীক।
প্রত্যেক বাতি জ্বালানোর সময় মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়—
“বুরো গিয়া ভালা আ, আপদ বালাই দূরে যা।”
যা এখনো বাংলার ঘরে ঘরে ভূত চতুর্দশীর চেনা সুর।

শারদোৎসবের পরের এই সংযমী তিথি আসলে প্রকৃতি ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষার প্রতীক। আধুনিক যুগে পুজোর আলো-আড়ম্বরের মাঝেও ভূত চতুর্দশী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কই জীবনের আসল শক্তি।













