চন্দ্রশেখর আজাদ: বিপ্লবী বীরের অমর কাহিনী

চন্দ্রশেখর আজাদ: বিপ্লবী বীরের অমর কাহিনী

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমন অনেক নাম আছে, যাঁরা নিজেদের প্রাণ বলিদান দিয়ে দেশকে দাসত্বের অন্ধকার থেকে মুক্ত করার সংকল্প নিয়েছিলেন। এমনই এক अद्भुत এবং প্রখর বিপ্লবী ছিলেন চন্দ্রশেখর আজাদ, যাঁর বীরত্ব, শৌর্য এবং নিষ্ঠা পুরো জাতিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি শুধুমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন না, বরং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতীকও ছিলেন।

প্রাথমিক জীবন এবং জন্মভূমি

চন্দ্রশেখর আজাদ ১৯০৬ সালের ২৩শে জুলাই মধ্যপ্রদেশের ভাবরা গ্রামে (যা এখন চন্দ্রশেখর আজাদনগর নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার বদরকা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর পিতা পণ্ডিত সীতারাম তিওয়ারি একজন শিক্ষিত এবং নিয়মানুবর্তী ব্যক্তি ছিলেন, যিনি দুর্ভিক্ষের সময় আলীরাজপুর রাজ্যে চাকরি করতেন। চন্দ্রশেখর তাঁর শৈশব আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কাটান, যেখানে তিনি ভিল শিশুদের সাথে ধনুক-তির চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এটাই ছিল তাঁর মধ্যে নিশানা এবং অস্ত্র দক্ষতার বীজ বপন।

শৈশব থেকেই দেশপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ

১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড পুরো ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তরুণ চন্দ্রশেখরও এতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে রাস্তায় নেমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। এই সময়ই প্রথম তিনি গ্রেফতার হন এবং শাস্তি হিসেবে তাঁকে ১৫টি বেত্রাঘাত করা হয়। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪-১৫ বছর। এই ঘটনা তাঁর মনোবলকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর লেখায় সেই ছোট ছেলেটির কথা উল্লেখ করেছেন, যে 'ভারত মাতা কি জয়' স্লোগান দিতে দিতে বেত্রাঘাত সহ্য করেছিল এবং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

রাজনৈতিক জীবন এবং অসহযোগ আন্দোলনের পর বিপ্লবী পথে

১৯২২ সালে চৌরিচৌরা ঘটনার পর গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে তরুণ বিপ্লবীরা হতাশ হয়ে পড়েন। চন্দ্রশেখর আজাদও কংগ্রেসের অহিংস পদ্ধতি নিয়ে অসন্তুষ্ট হন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন। পণ্ডিত রাম প্রসাদ বিসমিল, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জীর মতো বিপ্লবীদের সাথে মিলিত হয়ে তিনি হিন্দুস্তান প্রজাতান্ত্রিক সংঘ (HRA) প্রতিষ্ঠা করেন।

এই সংগঠন স্বাধীনতার জন্য ডাকাতি এবং অন্যান্য সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপ করত, যার উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। আজাদ তাঁর শৃঙ্খলা এবং আদর্শ দিয়ে কখনও নিরীহ মানুষের ক্ষতি করেননি। একবার একজন মহিলা তাঁর বন্দুক ছিনিয়ে নিলে, তিনি তাকে কোনো ক্ষতি করেননি, যা তাঁর মানবতা এবং নৈতিকতার পরিচয় ছিল।

কাকোরি কাণ্ড এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মশাল

১৯২৫ সালে কাকোরি কাণ্ড পুরো ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাম প্রসাদ বিসমিলের নেতৃত্বে একটি রেল ডাকাতি করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এই ঘটনার পর অনেক বিপ্লবীর ফাঁসি হয়, যাদের মধ্যে বিসমিলও ছিলেন। চন্দ্রশেখর আজাদ পলাতক হন কিন্তু তিনি তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে মিলে বিপ্লবী আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখেন। তাঁর দৃঢ় সংকল্প ছিল যে তিনি কোনো অবস্থাতেই ইংরেজদের হাতে ধরা দেবেন না এবং তিনি সবসময় আজাদ থাকবেন। সেইজন্যেই তিনি তাঁর উপাধি 'আজাদ' রেখেছিলেন।

হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন গঠন

১৯২৮ সালে চন্দ্রশেখর আজাদ উত্তর ভারতের বিভক্ত বিপ্লবী দলগুলোকে একত্রিত করে 'হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন' (HSRA) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন বিপ্লবীদের এক সূত্রে বেঁধে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র ও সংগঠিত সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ভগত সিং, রাজগুরু, সুখদেবের মতো মহান বিপ্লবীরাও এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। আজাদ এই সংগঠনের কমান্ডার-ইন-চিফের ভূমিকা পালন করেন এবং বিপ্লবীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।

লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জেমস স্যান্ডার্স লালা লাজপত রায়কে হত্যা করেছিলেন। চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিং এবং রাজগুরু ১৭ই ডিসেম্বর ১৯২৮ সালে লাহোরে স্যান্ডার্সকে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেন। এই সাহসী পদক্ষেপ পুরো দেশে বিপ্লবীদের জন্য সম্মান এবং জনসমর্থন বাড়িয়ে তোলে।

কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলিতে বোমা বিস্ফোরণ

৮ই এপ্রিল ১৯২৯ সালে চন্দ্রশেখর আজাদের তত্ত্বাবধানে ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলি ভবনে বোমা নিক্ষেপ করেন। এই বোমা বিস্ফোরণ কারও জীবন নেওয়ার জন্য ছিল না, বরং ইংরেজদের অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। এই ঘটনা বিপ্লবীদের জনসমর্থন এনে দেয় এবং ইংরেজ সরকারকে ভীত করে তোলে।

আজাদের রণকৌশল এবং সংগঠনের দৃঢ়তা

চন্দ্রশেখর আজাদ ঝাঁসি এবং কানপুরকে তাঁর প্রধান ঘাঁটি বানিয়েছিলেন। তিনি বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন, পরিকল্পনা তৈরি করতেন এবং দলের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্ট করতেন। তিনি সংগঠনের শৃঙ্খলা এবং কৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীনতার লড়াই শেষ পর্যন্ত চলবে এবং সেই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র 'হয় জিত অথবা মৃত্যু' হতে পারে।

আত্মত্যাগের মুহূর্ত এবং অমরত্ব

২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালে আজাদের শেষ লড়াই হয়েছিল। সিআইডি-র এসএসপি নট বাবরের পুলিশ দল আজাদকে ধরার জন্য চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। যখন পুলিশ তাঁর উপর হামলা করে, তখন তিনি সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন এবং তিনজন পুলিশ কর্মীকে হত্যা করেন। অবশেষে যখন তাঁর বন্দুকের শুধুমাত্র একটি গুলি অবশিষ্ট ছিল, তখন তিনি সেটি নিজের বুকে চালিয়ে দেন, যাতে তিনি ইংরেজদের হাতে ধরা না পড়েন। তাঁর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন উদ্দীপনা দেয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার সাথে সাথেই পুরো এলাহাবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। জনগণ তাঁর আত্মত্যাগকে স্মরণ করে তাঁর মহানুভবতাকে শ্রদ্ধা জানায়।

আজাদের ব্যক্তিত্ব এবং জীবন দর্শন

চন্দ্রশেখর আজাদের ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই প্রেরণাদায়ক। তিনি শুধুমাত্র একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন না, বরং উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষও ছিলেন। কাকোরি কাণ্ডের পর আত্মগোপন করার জন্য তিনি সাধুর বেশ ধারণ করেছিলেন, কিন্তু কখনও নিজের পরিচয় ত্যাগ করেননি। তিনি পড়ার চেয়ে বিপ্লবী গল্প শুনতে বেশি পছন্দ করতেন, যা তাঁকে উৎসাহিত করত। তাঁর জীবন এবং সংগ্রাম এই বার্তা দেয় যে, সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় সংকল্প এবং আত্মত্যাগ অপরিহার্য।

আজাদের উত্তরাধিকার এবং অনুপ্রেরণা

চন্দ্রশেখর আজাদ স্বাধীনতা সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা অমূল্য। তিনি দেশবাসীকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে চলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তাঁর আত্মত্যাগ হাজার হাজার যুবককে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে। ভারত সরকার ১৯৮৮ সালে তাঁর স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে এবং দেশের অনেক স্থানে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান, রাস্তা এবং শহর তৈরি করা হয়েছে। তাঁর বীরত্ব এবং নির্ভীকতা আজও যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

চন্দ্রশেখর 'আজাদ'-এর গল্প শুধুমাত্র একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প নয়, বরং এটি সাহস, আত্মসম্মান এবং দেশপ্রেমের গল্প। তাঁর আত্মত্যাগের কারণেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছে। আজও যখন আমরা তাঁর জীবনী পড়ি বা তাঁর বীরত্বের কাহিনী শুনি, তখন আমাদের মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বলে ওঠে।

Leave a comment