দলাই লামার উত্তরাধিকারী নিয়ে চীনের দাবির তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান পেনপা তসেরিং। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, চীনের দলাই লামার পুনর্জন্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। তসেরিং চীনের ‘গোল্ডেন আর্ন’ পদ্ধতিকে খারিজ করে দিয়ে বলেন, এটি তিব্বতি ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। একই সঙ্গে ব্যঙ্গ করে তিনি বলেন, যদি চীনের পুনর্জন্মের প্রক্রিয়ার ওপর এতই বিশ্বাস থাকে, তাহলে প্রথমে মাও সেতুং এবং জিয়াং জেমিনের মতো নেতাদের পুনর্জন্ম খুঁজে বের করা উচিত।
চীন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, দলাই লামার পরবর্তী নির্বাচন তার ‘গোল্ডেন আর্ন’ পদ্ধতি দ্বারা হবে, যা ১৭৯৩ সালে চিং রাজবংশের সময় থেকে চলে আসছে। কিন্তু তিব্বতের নির্বাসিত সরকার এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা এটি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তসেরিং বলেন, এর আগে আট জন দলাই লামা এই প্রক্রিয়া ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছিলেন, যা প্রমাণ করে যে, এই পদ্ধতি ঐতিহাসিকও নয়, আবার ধর্মীয়ও নয়।
দলাই লামার দ্ব্যর্থহীন বার্তা
ধর্মশালা থেকে প্রচারিত একটি ভিডিও বার্তায় দলাই লামা চীনকে কড়া জবাব দিয়ে বলেন যে, পরবর্তী দলাই লামা কে হবেন এবং কোথায় জন্ম নেবেন, সেই সিদ্ধান্ত কেবল তিব্বতি ঐতিহ্য এবং গার্ডেন পোডারন ট্রাস্টের মাধ্যমেই নেওয়া হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এতে চীন বা অন্য কোনো বহিঃশক্তির কোনো ভূমিকা থাকবে না। তিনি আরও বলেন যে, পরবর্তী দলাই লামা কোনো গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন দেশে জন্ম নেবেন, যা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, এই পুনর্জন্ম চীন বা তিব্বতে হবে না।
দলাই লামা এ কথাও স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং আগামী ২০ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকার আশা রাখেন। তিনি বলেন, যখন সময় আসবে, তখন তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেবেন। তাঁর এই বক্তব্যে তিব্বতি সম্প্রদায়ে উৎসাহ দেখা দিয়েছে, যেখানে চীন, ভারত এবং আমেরিকার মতো দেশগুলিতে এই বিষয় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে।
চীনের হস্তক্ষেপে তিব্বতি বৌদ্ধদের মধ্যে ক্ষোভ
তিব্বতি ধর্মগুরু এবং অনুসারীরা বলছেন যে, দলাই লামার উত্তরাধিকারীর পরিচয় একটি গভীর ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের দ্বারা কলুষিত করা যায় না। তাঁরা মনে করেন যে, চীন শুধুমাত্র তিব্বতের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করতে এই হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।
পেনপা তসেরিং আরও বলেন যে, চীন তিব্বতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে, কিন্তু তিব্বতি সমাজ এই চাপ সৃষ্টিকারী রাজনীতির কাছে নতি স্বীকার করবে না। তিনি বলেন, আমরা আমাদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে রাজনৈতিক খেলার অংশ হতে দেব না।
চীনের শর্তে দলাই লামার প্রত্যাবর্তন অসম্ভব
চীনের সরকার এর আগেও দলাই লামাকে তিব্বতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু শর্ত ছিল যে, তিনি যদি আসেন, তবে তাঁকে চিরকালের জন্য সেখানেই থাকতে হবে। এর উত্তরে দলাই লামা স্পষ্টভাবে বলেন যে, তিনি তিব্বতে আসতে পারেন, কিন্তু সেখানে থাকা সম্ভব নয়, কারণ সেখানে কোনো ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নেই। এই সংঘাত কেবল প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দলাই লামার ভবিষ্যতের পুনর্জন্ম নিয়েও রয়েছে।
চীন চায় যে, পরবর্তী দলাই লামা তার সমর্থক হোক, যাতে সে তিব্বতের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু দলাই লামা এবং তিব্বতি সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পুনর্জন্মের সিদ্ধান্ত তিব্বতি বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে হবে, কোনো রাজনৈতিক শক্তির নির্দেশে নয়।
দলাই লামার পুনর্জন্ম কিভাবে হয়
তিব্বতি বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে, দলাই লামার নির্বাচন কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি গভীর আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। মনে করা হয় যে, দলাই লামার মৃত্যুর পর তাঁর পুনর্জন্ম একজন নবজাতক বালকের রূপে হয়।
এই প্রক্রিয়ায় প্রবীণ ভিক্ষু স্বপ্ন, ঐশ্বরিক ইঙ্গিত, দেহের অবস্থা এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ধোঁয়ার দিকনির্দেশনার মতো বিভিন্ন উপাদানের বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা অনুমান করেন যে, নতুন দলাই লামা কোথায় জন্ম নিতে পারেন। এর পরে, তাঁরা হিমালয় অঞ্চলে সেই শিশুদের সন্ধান করেন, যারা সেই সময়ের কাছাকাছি সময়ে জন্ম নিয়েছে এবং যাদের মধ্যে বিশেষ গুণ দেখা যায়।
সেই শিশুদের পরীক্ষা করা হয় এবং তাঁদের দলাই লামার প্রিয় জিনিসপত্র দেওয়া হয়। যে শিশু সঠিক জিনিসগুলি শনাক্ত করতে পারে, তাকে সম্ভাব্য পুনর্জন্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পরে জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গণনা এবং ধর্মীয় আলোচনা করা হয় এবং নিশ্চিতকরণের পরে সেই শিশুকে নতুন দলাই লামা ঘোষণা করা হয়।
এর পরে, তাঁকে মঠে এনে বৌদ্ধ শিক্ষা, শৃঙ্খলা এবং দর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয়, যাতে তিনি ভবিষ্যতে তিব্বতি সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দিতে পারেন।
চীনের বিরোধিতায় একত্রিত হচ্ছে তিব্বতি সম্প্রদায়
দলাই লামার দেওয়া এই বিবৃতির পর তিব্বতি সম্প্রদায়ে একটি নতুন শক্তি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতি প্রবাসীরা এই বিবৃতিগুলিকে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন। আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত এবং নেপালে বসবাসকারী তিব্বতি সম্প্রদায় দলাই লামার সমর্থনে বিক্ষোভ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করেছে যে, তারা চীনের এই ধর্মীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক।
তিব্বতি বৌদ্ধদেরও ধারণা যে, ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো সরকারের হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই কারণে এই বিষয়টি এখন কেবল তিব্বত বা চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং একটি আন্তর্জাতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে।
পুনর্জন্মের কোনো ভূগোল হয় না
চীনের এই যুক্তি যে, পরবর্তী দলাই লামা তিব্বত বা চীনেই জন্ম নেবেন, তা বিশেষজ্ঞরাও সম্পূর্ণরূপে খারিজ করেছেন। বৌদ্ধ ইতিহাসে তৃতীয় দলাই লামা মঙ্গোলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে ষষ্ঠ দলাই লামা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর সরাসরি অর্থ হল, পুনর্জন্ম কোনো দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না।
তিব্বতি বৌদ্ধ ঐতিহ্য মনে করে যে, পুনর্জন্ম আত্মার স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা হয় এবং এটি কোনো সরকার বা রাজনৈতিক সত্তার নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে না।
দলাই লামার উত্তরাধিকারী নিয়ে চীন এবং তিব্বতি সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা এখন প্রকাশ্যে এসেছে। একদিকে চীন, যারা ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চায়, অন্যদিকে তিব্বতি সরকার এবং দলাই লামা রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
এই সংঘাত কেবল ধর্মীয় অধিকারের লড়াই নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইও। এখন দেখার বিষয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিতর্কের বিষয়ে কী অবস্থান নেয় এবং তারা তিব্বতের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় কিনা।