শরতের হাওয়া বইছে, শহর ঢেকে যাচ্ছে উৎসবের আলোয়
বর্ষা বিদায় নিলেও ভাদ্রের আকাশ এখনও বৃষ্টিতে ভেজা। তবে শরতের আগমন স্পষ্ট—নীল আকাশ, তুলোর মতো মেঘ আর উৎসবের আমেজে ঝলমল করছে কলকাতা। শহরের রাস্তায় শুরু হয়েছে আলো ঝাড়াই, ম্যারাপ টাঙানোর কাজ। তবে এই আনন্দের সঙ্গে লুকিয়ে রয়েছে আশঙ্কাও। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন— উৎসব যত জাঁকজমকপূর্ণ হবে, দূষণও তত বাড়বে।
পুজো এলে বাড়ে শব্দ, ধোঁয়া আর বর্জ্যের চাপ
দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে কালীপুজো, দীপাবলি, ছট বা বড়দিন— প্রতিটি উৎসবেই শহরের দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য— সব মিলিয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, প্রতিবছরই প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হলেও কার্যকরী পদক্ষেপ হয় না বললেই চলে।
চন্দননগর থেকে রাজ্য প্রশাসনের উদ্দেশে আবেদন
চন্দননগরের পরিবেশ আকাদেমির পক্ষ থেকে সভাপতি বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় সরাসরি মুখ্যসচিব, পরিবেশ দপ্তরের প্রধান সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদস্য-সচিবকে আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে— উৎসবের সময় আইন প্রয়োগের অভাবে শব্দবাজি, প্লাস্টিক ও প্রতিমা বিসর্জনের বর্জ্য শহরের পরিবেশকে ভয়ঙ্করভাবে নষ্ট করছে।
আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, ফল ভুগছে মানুষ
২০১৬ সালের প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন, সুপ্রিম কোর্টের বাজি পোড়ানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা— সবই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে উৎসবের দিনে কোনও নিয়মই মানা হয় না। প্রশাসনের শিথিল মনোভাবের সুযোগ নিয়ে বেআইনি আতশবাজি কারখানাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সুভাষ দত্ত ও নব দত্ত সহ একাধিক পরিবেশকর্মী অভিযোগ করেছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।
শব্দবাজি ও ডিজে সংস্কৃতিতে শহর হাঁপাচ্ছে
পরিবেশকর্মীদের অন্যতম দাবি— অনুমতি ছাড়া যেন কোনও মাইক্রোফোন ব্যবহার না হয়। সব সাউন্ড সিস্টেমে সাউন্ড লিমিটার বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ থেকে শুরু করে বিসর্জনের শোভাযাত্রা— সর্বত্র ডিজে বক্সের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ এই প্রবল শব্দ শহরের বয়স্ক, অসুস্থ ও শিশুদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করার দাবি
সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, কালীপুজো ও দীপাবলিতে রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্তই বাজি পোড়ানো যাবে। ছটপুজোয় সকাল ৬টা থেকে ৮টা, আর বড়দিন ও নববর্ষের রাতে মাত্র ৩৫ মিনিট। তাছাড়া বাংলায় শুধুমাত্র সবুজ আতশবাজি ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ম কার্যকর হচ্ছে না। বরং শব্দবাজি ও ক্ষতিকর আতশবাজির দাপট ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
প্লাস্টিক ও থার্মোকল বর্জনের সঠিক ব্যবস্থা নেই
প্রতিমা তৈরিতে এখনও থার্মোকল, প্লাস্টিক এবং কৃত্রিম রংয়ের ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো জলাশয়ে মিশে ভয়াবহ দূষণ ঘটাচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও অনেক সময় তা মানা হয় না। ফলে প্রতিমা বিসর্জনের পর গঙ্গা ও অন্যান্য নদীতে ভেসে থাকে অসংখ্য ক্ষতিকর পদার্থ। পরিবেশবিদরা চাইছেন, এ বিষয়ে এবারই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অতিরিক্ত উদ্যোগ প্রয়োজন
শুধু দূষণ নয়, ভিড় নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিধিও বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ আকাদেমি জানিয়েছে, মণ্ডপের আশেপাশে বায়ো-টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকলে নোংরা আবর্জনায় পরিবেশ আরও নষ্ট হবে। তাই পুরসভার তরফে এই বিষয়ে নজরদারি প্রয়োজন। উৎসবের আনন্দ যেমন জরুরি, তেমনই জনস্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন না হলে ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় সরাসরি বলেছেন— বছরের পর বছর আদালতের নির্দেশ অমান্য হচ্ছে। ফলেই শহরে শব্দ ও বায়ুদূষণ ভয়ঙ্কর মাত্রা নিয়েছে। উৎসবের আনন্দ থাক, তবে পরিবেশরক্ষার দায়িত্বও পালিত হোক। একই সুরে সুভাষ দত্তের দাবি— উৎসবের অনুমতিপত্রে পরিবেশবিধি স্পষ্ট করে লিখে দেওয়া উচিত, যাতে আয়োজকেরা অজ্ঞতার অজুহাত না দিতে পারেন।
কঠোর আইন প্রয়োগই একমাত্র সমাধান
সবুজ মঞ্চর সাধারণ সম্পাদক নব দত্তর মতে— প্রশাসন যদি সত্যিই আইন প্রয়োগে কঠোর হয়, তবে অনেকেই নিয়ম মানতে বাধ্য হবে। কিন্তু শিথিল ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই সাধারণ মানুষ থেকে আয়োজকেরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তাঁর বক্তব্য, “উৎসব আনন্দের প্রতীক, কিন্তু সেই আনন্দ যদি পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।