গোবিন্দ গুরু ছিলেন বানজারা আদিবাসী সমাজের মহান সন্ত ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি রাজস্থান, গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশে সামাজিক সংস্কার ও জনজাগরণ করেন। ভগত আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি মদ, মাংস ও অন্যান্য কুপ্রথা থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেন।
গোবিন্দ গুরু: ভারতের ইতিহাস বহু মহান ব্যক্তিত্বে পরিপূর্ণ, যাঁরা তাঁদের দেশ ও সমাজের জন্য অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন গোবিন্দ গুরু বানজারা, যিনি শুধুমাত্র আদিবাসী সমাজে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের অগ্রদূত হিসেবেই পরিচিত নন, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনাপতি হিসেবেও স্মরণীয়। গোবিন্দ গুরু রাজস্থান, গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে জনজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর জীবন আদিবাসী সমাজের দৈন্যদশা এবং ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদাহরণ।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
গোবিন্দ গুরু বানজারা ১৮৫৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ডুঙ্গারপুর জেলার বাঁশিয়া (বেদসা) গ্রামে এক বানজারা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব সাধারণ ছিল না; তিনি কেবল শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন তাই নয়, আধ্যাত্মিকতার দিকেও তাঁর ঝোঁক ছিল। শৈশব থেকেই তাঁর মন ধর্মীয় জ্ঞান এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে আকৃষ্ট ছিল। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে গোবিন্দ গুরু আদিবাসী সমাজ ও দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি কোনো আধুনিক স্কুল বা কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেননি এবং কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণও নেননি। তা সত্ত্বেও, তাঁর দূরদর্শিতা এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁকে এমন এক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যিনি আদিবাসী সমাজে সামাজিক ও ধর্মীয় সচেতনতার ঢেউ তোলেন।
ভগত আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কার
১৮৯০-এর দশকে গোবিন্দ গুরু ভগত আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী সমাজকে সামাজিক কুপ্রথা থেকে দূরে রাখা এবং তাঁদের ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনা সম্পর্কে সচেতন করা। তিনি অগ্নিদেবতাকে এই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। অনুগামীদের পবিত্র অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে পূজা ও যজ্ঞ (ধুনী) করার শিক্ষা দেওয়া হত।
১৮৮৩ সালে তিনি ‘সম্প সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি মদ, মাংস, চুরি, ব্যভিচারের মতো খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার বার্তা দেন। এছাড়াও, তিনি অনুগামীদের পরিশ্রম করতে, সাদাসিধে জীবনযাপন করতে, প্রতিদিন স্নান, যজ্ঞ ও কীর্তন করতে, সন্তানদের শিক্ষা দিতে, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিবাদ মীমাংসা করতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে দেশীয় জিনিস ব্যবহার করার শিক্ষা দেন।
কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর অনুগামীর সংখ্যা লক্ষ লক্ষ হয়ে যায়। মার্গশীর্ষ পূর্ণিমায় বার্ষিক মেলার আয়োজন করা হত, যেখানে লোকেরা যজ্ঞ ও ভজনের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভিজ্ঞতা লাভ করত। এইভাবে ওয়াগড় অঞ্চল ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সরকার এবং স্থানীয় সামন্তদের বিরোধিতার আগুনে জ্বলতে শুরু করে।
মানগড়ের ঘটনা ও সংঘর্ষ
১৯১৩ সালের ১৭ নভেম্বর মানগড় পাহাড়ে বার্ষিক মেলা হওয়ার কথা ছিল। গোবিন্দ গুরু এর আগে প্রশাসনকে চিঠি লিখে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত আদিবাসীদের উপর কর কমানো হোক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য পালনের অনুমতি দেওয়া হোক। কিন্তু প্রশাসন তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে পাহাড় ঘিরে ফেলে এবং মেশিনগান ও কামান মোতায়েন করে।
যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মেলা দেখতে আসেন, তখন কর্নেল সাটনের নেতৃত্বে পুলিশ গুলি চালায়। এই হিংসাত্মক ঘটনায় প্রায় ১,৫০০ জন মানুষ মারা যান। গোবিন্দ গুরুকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রথমে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জেল ও পরবর্তী জীবন
১৯২৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গোবিন্দ গুরু ভিল সেবা সদন, ঝালোদের মাধ্যমে লোকসেবার বিভিন্ন কাজ করেন। তাঁর জীবন আদিবাসী সমাজের কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল। ১৯৩১ সালের ৩০ অক্টোবর গ্রাম কাম্বোই (গুজরাট)-এ তাঁর মৃত্যু হয়। আজও তাঁর সমাধিস্থলে মার্গশীর্ষ পূর্ণিমার দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সাহিত্যিক অবদান ও জনজাগরণ
গোবিন্দ গুরু তাঁর আদর্শ ও বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাহিত্য ও গানের সাহায্য নেন। তিনি তাঁর গরবোলি ও আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়ে মানুষকে সচেতন করতেন। তাঁর গানে ইংরেজদের অন্যায় নীতির বিরোধিতা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, তাঁর গানে এটা স্পষ্ট যে তিনি ইংরেজদের কাছে দেশের মাটির অধিকার দাবি করছিলেন এবং এই বার্তা দিচ্ছিলেন যে "পুরো দেশ আমাদের এবং আমরা এটিকে ইংরেজদের থেকে মুক্ত করব"।
তাঁর ভজন ও গানে রাজনৈতিক চেতনার পাশাপাশি সামাজিক সংস্কারের বার্তাও ছিল। তিনি রাজস্থানী হিন্দি ব্যবহার করতেন যাতে এই ভাষা আদিবাসী সমাজ ও সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারে।
আদিবাসী সমাজের উপর প্রভাব
গোবিন্দ গুরু আদিবাসী সমাজে সামাজিক ও ধর্মীয় সচেতনতার এক নতুন ঢেউ তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে আদিবাসী সমাজ মদ, মাংস, চুরি এবং অন্যান্য খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকে। তাঁর অনুগামীরা কঠোর পরিশ্রম ও সততার সাথে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। তিনি শিক্ষা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং দেশীয় জিনিস ব্যবহারের প্রচার করেন।
তাঁর এই প্রচেষ্টা কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি জাতীয় চেতনারও মাধ্যম হয়ে ওঠে। আদিবাসী সমাজ তাঁর নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করে এবং মাতৃভূমির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে।
গোবিন্দ গুরুর পরিবার ও উত্তরাধিকার
গোবিন্দ গুরুর বড় ছেলে হরিগিরির পরিবার বাঁশিয়ায় এবং ছোট ছেলে অমরুগিরির পরিবার বাঁশওয়াড়া জেলার তলওয়াড়ার কাছে উমরাইতে বসবাস করেন। গোবিন্দ গুরুর উত্তরাধিকার আজও তাঁর ষষ্ঠ প্রজন্মের পরিবারের মাধ্যমে সংরক্ষিত হচ্ছে। তাঁর ছেলে গোপালগিরি এবং অন্যান্য বংশধররা গুরুর উপদেশগুলি জীবনে অনুসরণ করে সমাজে প্রচারের কাজ করছেন।
আজও বানজারা ও আদিবাসী সমাজ তাঁকে তাঁদের আরাধ্য দেবতা মনে করে। তাঁর ভজন ও গান আজও প্রচলিত এবং সমাজে তাঁর আদর্শ প্রচার করে।
গোবিন্দ গুরু ও জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম
গোবিন্দ গুরুর অবদান শুধুমাত্র আদিবাসী সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কও ছিলেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের ইংরেজদের নীতির প্রতি সচেতন করেন এবং তাঁর গান ও আন্দোলনের মাধ্যমে দেশাত্মবোধের চেতনা জাগিয়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী তাঁদের মাটি ও অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে অনুপ্রাণিত হন।
তাঁর দূরদর্শিতা, সাহস এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই বীর নেতাদের মধ্যে স্থান দিয়েছে, যাঁরা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্যও সংগ্রাম করেছিলেন।
গোবিন্দ গুরু বানজারার জীবন আদিবাসী সমাজ ও দেশের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি সামাজিক সংস্কার, ধর্মীয় সচেতনতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব এবং উৎসর্গ আজও আদিবাসী সম্প্রদায় এবং দেশপ্রেমিকদের জন্য পথপ্রদর্শক। তাঁর বার্তা আজও মানুষকে ন্যায়, ঐক্য এবং দেশপ্রেমের পথ দেখায়।