ভারত এবং ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া ইএফটিএ চুক্তি আগামী ১৫ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং ১০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভারতের উৎপাদন ও রপ্তানিকে উৎসাহিত করা হবে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি ২০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের বৃদ্ধি: ভারত এবং ইউরোপীয় ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ) এর মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে আগামী ১৫ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং ১০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান তৈরির একটি বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফিক্কির ডিজি জ্যোতি ভিজের মতে, এই বিনিয়োগ ভারতের ৪ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ প্রমাণ হবে। ইএফটিএ শুধুমাত্র 'মেক ইন ইন্ডিয়া' কে শক্তিশালী করবে না বরং ইউরোপের সাথে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
ইএফটিএ চুক্তি থেকে বিনিয়োগের নতুন পথ উন্মোচন
ইএফটিএ-তে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড এবং লিচেনস্টাইন অন্তর্ভুক্ত। এই দেশগুলোর সাথে ভারতের এই চুক্তি ঐতিহ্যবাহী মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে ভিন্ন। এই চুক্তিতে শুধুমাত্র শুল্ক ছাড়ই নয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বাধ্যতামূলক শর্তও যুক্ত করা হয়েছে। এতে স্থির করা হয়েছে যে আগামী ১৫ বছরে ইএফটিএ দেশগুলো ভারতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং এর ফলে সরাসরি ১০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এই চুক্তি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং স্থানীয় উৎপাদনকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভারতের অর্থনীতির জন্য একটি বড় মোড়
ফিক্কির মহাপরিচালক জ্যোতি ভিজ বলেছেন যে, এই চুক্তি ভারতের অর্থনৈতিক যাত্রায় একটি মাইলফলক প্রমাণ হতে পারে। তার মতে, ভারত বর্তমানে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, কিন্তু বিনিয়োগের গতি যদি এভাবেই বজায় থাকে, তবে আগামী ১৫ বছরে ভারত ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে। এর জন্য বিনিয়োগের হার বর্তমান ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৩ থেকে ৩৪ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি জানান যে, গত দশ বছরে ভারতে এফডিআই-এর গড় অংশ প্রায় ৮.৩ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে, গত ১১ বছরে মোট এফডিআই-এর পরিমাণ প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে, ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারতকে ২০৩৫ সালের মধ্যে ২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে হবে।
কম সময়েই সম্পন্ন হতে পারে ১০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত-ইএফটিএ সমৃদ্ধি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় পক্ষই বিনিয়োগের বিষয়ে উৎসাহ দেখিয়েছে। ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে, ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করা যেতে পারে। যদি ভারত আগামী ১০ বছরে ইএফটিএ থেকে ৭৫ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়, তবে এই দেশগুলোর ভারতের মোট এফডিআই-এর অংশীদারিত্ব বর্তমান ১.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
ভারত-ইএফটিএ বাণিজ্য বর্তমানে সামান্য স্তরে
বর্তমানে ভারত এবং ইএফটিএ দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক পরিসংখ্যান খুব বেশি বড় নয়। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে উভয় পক্ষের মধ্যে মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ২৪.৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতের রপ্তানি ছিল মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে সোনার আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। টেপা চুক্তির পর এই ব্যবধান ধীরে ধীরে কমার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এখন ইএফটিএ ভারত থেকে আসা ৯৯.৬ শতাংশ রপ্তানির উপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে।
কৃষি খাতেও ভারত বড় সুবিধা পেতে পারে। আঙ্গুর, চাল, সবজি, বাদাম, বীজ, সামুদ্রিক পণ্য, কফি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার (processed food) মতো পণ্যের উপর শুল্ক বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ভারতীয় কৃষক এবং রপ্তানিকারকরা ইউরোপীয় বাজারে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ পাবেন।
উৎপাদন খাতের জন্য নতুন সুযোগ
টেপা চুক্তির আওতায় ভারতের উৎপাদন খাতও বড় সুবিধা পেতে চলেছে। বিশেষ করে ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, অ্যালুমিনিয়াম এবং কপার পণ্যের রপ্তানিকারকরা ইউরোপীয় বাজারে নতুন প্রবেশাধিকার পাবেন। ভারত তার ৮২.৭ শতাংশ শুল্ক লাইন ইএফটিএ দেশগুলোর জন্য খুলে দিয়েছে, যার ফলে তারাও ভারতীয় বাজারে আরও ভালো প্রবেশাধিকার পেয়েছে। তবে, কৃষির মতো সংবেদনশীল খাতগুলোকে এখনো সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
সোনার উপর আরোপিত শুল্কে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এই সিদ্ধান্ত ভারতের আর্থিক স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের সোনা আমদানি ব্যবসার উপর কোনো অতিরিক্ত চাপ পড়বে না।
ইউরোপের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত হবে
ইএফটিএ ছাড়াও ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। একই সাথে, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সিইটিএ (CETA) চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত-ইউরোপ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। এর ফলে ভারত ইউরোপে শুধু বাণিজ্যিক নয়, প্রযুক্তিগত এবং শিল্পগত সহযোগিতাও পাবে।