এক কর থেকে আরেক কর: নতুন সংস্কারের পথে ভারত
২০১৭ সালে চালু হয়েছিল জিএসটি বা পণ্য ও পরিষেবা কর, যেটি এক জাতি এক কর ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের একাধিক জটিল করের পরিবর্তে এই একক ব্যবস্থা কেনাকাটাকে সহজ করে দেয়। তবে এতদিন ধরে সিস্টেম অপরিবর্তিত ছিল। এবার কেন্দ্র সরকার আনছে জিএসটি ২.০, যেটিকে বড়সড় সংস্কার হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন কাঠামো শুধু করের বোঝা কমাবে না, গ্রাহকের হাতে আরও টাকা ফেরত পাঠাবে।
চার থেকে দুই স্ল্যাবে: সহজ হবে করের হিসেব
এখনকার জিএসটি-তে চারটি স্ল্যাব রয়েছে—৫%, ১২%, ১৮% ও ২৮%। নতুন সংস্কারে এগুলো কমে হবে মাত্র দুটি প্রধান হার। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকবে ৫% স্ল্যাবে, আর অধিকাংশ অন্য পণ্য থাকবে ১৮% হারে। এর বাইরে তামাক, অ্যালকোহল ও বিলাসপণ্যের জন্য আলাদা উচ্চ করহার নির্ধারিত থাকবে। ফলে দীর্ঘদিনের জটিল করের হিসেব অনেকটাই সহজ হবে।
মুদ্রাস্ফীতির চাপে গৃহস্থ: স্বস্তি দিতে আসছে সংস্কার
দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ দিন দিন বাড়ছে। বাজারের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই কর সংস্কার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াবে, খরচ বাড়াবে এবং কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করবে। পাশাপাশি ভারতীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। অর্থনীতির গতি বাড়াতে এ এক বড় পদক্ষেপ।
দীপাবলির আগেই সুখবর: হালকা হবে বাজারের ঝুলি
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খবর হলো, দীপাবলির আগেই চালু হতে পারে জিএসটি ২.০। ফলে উৎসবের মরশুমে দাম কমতে পারে মুদিখানা, প্রসাধনী, ছোট গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালির জিনিসপত্রে। যেসব পণ্যে এখন ২৮% কর দিতে হয়, তার ৯০% নেমে আসবে ১৮%-এ। এমনকি ১২% স্ল্যাবের অনেক জিনিস চলে আসবে ৫%-এ।
জিএসটি কীভাবে কাজ করে? পুরনো কাঠামোর ব্যাখ্যা
২০১৭ সালের জুলাইয়ে চালু হয়েছিল জিএসটি। তখন বলা হয়েছিল এক জাতি, এক কর ব্যবস্থা। এখনকার কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন ওষুধ, জুতো বা প্যাকেটজাত খাবার রয়েছে ৫% স্ল্যাবে। বিস্কুট বা প্রসেসড ফুড পড়ে ১২%-এ। মোবাইল ফোন বা সাধারণ পরিষেবা রয়েছে ১৮%-এ। আর বিলাসপণ্য যেমন বড় গাড়ি, সিমেন্ট বা এসি পড়ে ২৮%-এ। সমালোচনার জায়গা ছিল—দৈনন্দিন কিছু জিনিসেও তুলনামূলক বেশি কর বসানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিত: দ্বিগুণ দীপাবলির উপহার
স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম ইঙ্গিত দেন এই সংস্কারের। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ হবে ‘‘দ্বিগুণ দীপাবলির উপহার’’। কারণ এতে পরিবারের মাসিক ব্যয় হালকা হবে, ব্যবসার উপর থেকে চাপ কমবে এবং অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স ও বিমা খাতে নতুন চাহিদা তৈরি হবে। অর্থাৎ, শুধু ভোক্তাই নয়, শিল্পখাতও লাভবান হবে।
কোন কোন জিনিস সস্তা হবে?
নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্যের মধ্যে সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, বিস্কুট, জুস ইত্যাদির দাম পড়ে যেতে পারে। দুধজাত পণ্য যেমন ঘি, কনডেন্সড মিল্ক, সাইকেল, স্টেশনারি এবং সাশ্রয়ী পোশাকও ৫% স্ল্যাবে চলে আসতে পারে। এর ফলে প্রতিদিনের খরচে বড় সাশ্রয় হবে।
যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক্স: বড় কাটছাঁটের সম্ভাবনা
এসি, ফ্রিজ, ডিশওয়াশার, বড় টিভি স্ক্রিন, এমনকি সিমেন্টের মতো জিনিসে এখন ২৮% জিএসটি বসে। নতুন ব্যবস্থায় এগুলো নেমে আসতে পারে ১৮%-এ। এতে ৭-৮% পর্যন্ত সস্তা হতে পারে দাম। মধ্যবিত্তের জন্য এটি বিশাল স্বস্তি, কারণ এই ধরনের কেনাকাটা অনেক দিন ধরে পিছিয়ে রাখছিলেন অনেকে।
অটোমোবাইল খাতে চাঙ্গাভাব
গাড়ি শিল্পে জিএসটি ২.০ হতে পারে গেমচেঞ্জার। ছোট গাড়ি ও দুই চাকার যানবাহনে কর ২৮% থেকে কমে ১৮% হতে পারে। এতে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছে মারুতি সুজুকি, হুন্ডাই, টাটা মোটরসের মতো কোম্পানিগুলি। তবে বড় বিলাসবহুল গাড়ি ও এসইউভি-তে উচ্চ কর বজায় থাকবে।
বিমা ও আর্থিক পরিষেবায় স্বস্তি
এখন বিমা প্রিমিয়ামে ১৮% জিএসটি বসে, যা অনেকের নাগালের বাইরে। নতুন কাঠামোয় এই হার কমতে পারে বা কিছু ক্ষেত্রে ছাড়ও দেওয়া হতে পারে। ফলে পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা বাড়বে, স্বাস্থ্য বা জীবন বিমা গ্রহণ সহজ হবে।
কোন কোন জিনিস দামি থাকবে?
সব পণ্য কিন্তু সস্তা হবে না। সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে, তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল, পান মশলা, অনলাইন গেমিং বা বেটিং প্ল্যাটফর্মে বাড়তি কর আরোপ করা হবে। এগুলো থাকবে ৪০% ‘‘পাপ কর’’ স্ল্যাবে। পাশাপাশি জ্বালানি বা পেট্রোল পণ্য এখনই জিএসটির আওতায় আসছে না। হিরে ও বিলাসবহুল পণ্যের দামও উঁচুতেই থাকবে।
অর্থনীতির জন্য লাভ
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.৭-০.৮ শতাংশ বাড়তে পারে। শেয়ারবাজার ইতিমধ্যেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। নিফটি৫০ সূচক ঘোষণার পরই ১% বেড়েছে, আর গাড়ি ও ভোগ্যপণ্যের শেয়ার সবচেয়ে বেশি উত্থান দেখিয়েছে। উৎসবের মরশুমে কেনাকাটার ঝোঁক আরও বাড়বে।
প্রতিদিনের প্রভাব: সস্তা শপিং, বড় সাশ্রয়
গ্রাহকের কাছে পরিবর্তনগুলো ধরা দেবে তিনভাবে—প্রথমত, দৈনন্দিন কেনাকাটা সস্তা হবে। দ্বিতীয়ত, এসি, টিভি বা গাড়ির মতো বড় কেনাকাটায় উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় আসবে। তৃতীয়ত, বিমার প্রিমিয়াম কমলে মাসিক বাজেট সামলানো সহজ হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও করভার হালকা হবে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য।
উৎসবের আগে বড় খুশির বার্তা
দীপাবলির আগেই চালু হতে পারে এই সংস্কার। অর্থাৎ, উৎসবের আবহে মানুষ আরও বেশি কেনাকাটায় ঝুঁকবে। তবে সবটাই নির্ভর করছে রাজ্যগুলির সহযোগিতা ও কার্যকর বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু একথা বলাই যায়—জিএসটি ২.০ সাধারণ মানুষের পকেটে বাড়তি টাকা ফেরত আনতে চলেছে।