গুরুগ্রামে মেয়ের সাফল্য, বাবার হাতেই খুন: সমাজের সংকীর্ণতার ফল?

গুরুগ্রামে মেয়ের সাফল্য, বাবার হাতেই খুন: সমাজের সংকীর্ণতার ফল?

হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে আসা একটি বেদনাদায়ক ঘটনা গোটা সমাজকে আয়না দেখিয়েছে। ২৫ বছর বয়সী রাজ্য স্তরের টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদবকে তাঁরই বাবা গুলি করে হত্যা করেছেন। ঘটনাটি বৃহস্পতিবার সকালে, ওয়াজিরাবাদ গ্রামে ঘটে, যখন রাধিকা তাঁর অসুস্থ মায়ের জন্মদিনের জন্য রান্নাঘরে খাবার তৈরি করছিলেন। রাধিকার পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবা দীপক যাদব ৩২ বোরের লাইসেন্স করা রিভলবার দিয়ে তিনটি গুলি করেন, যার ফলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এটি কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা বা বাইরের আক্রমণ ছিল না, বরং একজন পিতার মানসিক অবসাদ এবং সমাজের কটূক্তির ফলস্বরূপ সৃষ্ট সেই রাগ ছিল, যা তাঁর মেয়ের জীবন কেড়ে নিয়ে শান্ত হয়েছে। মেয়ের সাফল্য এবং স্বনির্ভরতা সমাজের কিছু মানুষের কাছে এতটাই খারাপ লেগেছিল যে, তারা লাগাতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে পিতাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়, যার ফলস্বরূপ তিনি তাঁর নিজের মেয়ের হত্যাকারী হয়ে ওঠেন।

খেলোয়াড় থেকে কোচে পরিণত হওয়া রাধিকা

পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, রাধিকা যাদব একজন প্রতিভাবান টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি রাজ্য স্তরে অনেক পদক জয় করেছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে কাঁধে গুরুতর চোট পাওয়ার কারণে তাঁর ক্যারিয়ারে বাধা আসে। হার না মেনে রাধিকা টেনিস ছেড়ে কোচিংয়ের জগতে পা রাখেন এবং নিজের একাডেমি শুরু করেন। তাঁর একাডেমি ধীরে ধীরে সাফল্যের পথে হাঁটতে শুরু করে এবং অনেক তরুণ খেলোয়াড়কে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন তিনি।

রাধিকার পরিশ্রম ফল দিচ্ছিল, কিন্তু এই স্বনির্ভরতা সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতাকে ভালো লাগেনি। পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দীপক যাদবকে বারবার কথা শুনতে হয়েছে—‘মেয়ের রোজগারে খাচ্ছিস’, ‘ছেলে থাকলে এমন দিন দেখতে হতো না’—ইত্যাদি কথাগুলো তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে দীপক রাধিকার কাছে তাঁর একাডেমি বন্ধ করার জন্য জেদ ধরেন। কিন্তু যখন রাধিকা তাঁর স্বপ্ন ত্যাগ করতে রাজি হননি, তখন বাবা এমন একটি সিদ্ধান্ত নেন যা পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।

মায়ের জন্মদিনে মেয়ের হত্যা

১০ জুলাই সকালে রাধিকার মা মঞ্জু যাদবের জন্মদিন ছিল। বাড়ির পরিস্থিতি তেমন ভালো ছিল না, কারণ মায়ের শরীর ভালো ছিল না। রাধিকা সকাল ১০:৩০টা নাগাদ রান্নাঘরে মায়ের জন্য খাবার বানাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁর বাবা পিছন থেকে এসে তিনটি গুলি করেন। গুলির শব্দে বাড়িতে চিৎকার শুরু হয়, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাধিকার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

ঘটনাটি গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৭-এর কাছে অবস্থিত ওয়াজিরাবাদ গ্রামের। খবর পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত লাইসেন্স করা রিভলবারটি উদ্ধার করে এবং অভিযুক্ত বাবা দীপক যাদবকে গ্রেপ্তার করে। প্রথমে পরিবারের সদস্যরা এই হত্যা সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি, কিন্তু যখন পুলিশ তদন্ত শুরু করে, তখন আসল ঘটনা সামনে আসে—মেয়ের হত্যা তাঁর বাবাই করেছেন।

সমাজের চিন্তাভাবনা কেড়ে নিল একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

রাধিকা যাদব শুধু নিজে একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিলেন না, বরং তিনি অনেক তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য অনুপ্রেরণাও ছিলেন। তাঁর মধ্যে শুধু দক্ষতা ছিল না, নিজের চেষ্টায় কিছু করে দেখানোর মতো জেদও ছিল। কিন্তু এই সাহস সমাজের সেই পুরনো চিন্তাধারার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা আজও ছেলেকে পরিবারের 'রোজগারের মেশিন' হিসেবে বিবেচনা করে এবং মেয়ের সাফল্যকে সন্দেহের চোখে দেখে।

প্রতিবেশীদের কটূক্তি, আত্মীয়দের কথা এবং সামাজিক চাপ দীপক যাদবের মতো পিতাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় সুখকেই শেষ করে দেন। এই ঘটনা শুধু একটি হত্যা নয়, এটি সেই মানসিকতার ব্যর্থতার গল্প যা আজও নারী সাফল্যকে হজম করতে পারে না।

Leave a comment