ভারতের পবিত্র ভূমিতে হাজারো মন্দির রয়েছে, কিন্তু কিছু মন্দির কেবল আস্থার কেন্দ্র নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার এক মিলনস্থলও বটে। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত দ্বারকাধীশ মন্দির (যাকে জগৎ মন্দিরও বলা হয়), শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপের পূজার স্থান নয়, এটি চার ধামের মধ্যে অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থানও বটে। দ্বারকাকে শ্রীকৃষ্ণের কর্মভূমি হিসেবে মানা হয় এবং এই মন্দির সেই দিব্য নগরীর হৃদয়ে অবস্থিত। এই প্রবন্ধে আমরা এই মন্দিরের ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
দ্বারকাধীশ মন্দিরের প্রাচীন ইতিহাস
দ্বারকাধীশ মন্দিরের ঐতিহাসিক শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, এই মন্দিরের মূল কাঠামো খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি বহু আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৫-১৬ শতকের মধ্যে এর পুনর্নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয়, যখন দ্বারকার ওয়াঘের সম্প্রদায় মন্দির রক্ষার চেষ্টা করেছিল, তখন মাহমুদ বেগড়া ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন। এই ঘটনাটি মন্দিরের গৌরবময় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এরপর ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে, অনাদি আশ্রম শঙ্করাচার্যের দ্বারা মন্দিরটি পুনরায় স্থাপিত হয় এবং দ্বারকাধীশের বর্তমান মূর্তি স্থাপন করা হয়।
ধর্মীয় গুরুত্ব ও চার ধামের সঙ্গে সম্পর্ক
দ্বারকাধীশ মন্দির হিন্দু ধর্মের চার ধামের মধ্যে পশ্চিম দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্য তিনটি ধাম হল – বদ্রীনাথ (উত্তর), রামেশ্বরম (দক্ষিণ) এবং পুরী (পূর্ব)। আদি শঙ্কর এই মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন এবং এর কাছেই দ্বারকা পীঠ স্থাপন করেছিলেন, যা হিন্দু ধর্মের অদ্বৈত বেদান্ত ঐতিহ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই মন্দির বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত এবং ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত। এই স্থান দিব্য দেশমের তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত, যা বৈষ্ণবদের জন্য ১০৮টি পবিত্র স্থানের মধ্যে অন্যতম।
দ্বারকাধীশ মন্দিরের পৌরাণিক কথা
মহাভারত ও অন্যান্য গ্রন্থ অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করার পর তাঁর যদুবংশীয়দের রক্ষা করার জন্য সমুদ্রের তীরে একটি নতুন নগরী স্থাপন করেন, যা দ্বারকা নামে পরিচিত হয়। এই ভূমি সমুদ্র থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। একটি লোককথানুসারে, একবার ঋষি দুর্বাসা কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি এই দম্পতিকে রথে করে নিয়ে যেতে বলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী বিনম্রভাবে তা করেন। পথে রুক্মিণী ক্লান্ত হয়ে জল চাইলে, শ্রীকৃষ্ণ মাটি থেকে গঙ্গা জল সৃষ্টি করেন। এতে ঋষি দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হয়ে রুক্মিণীকে সেখানেই থাকার অভিশাপ দেন। আজও রুক্মিণী দেবীর মন্দির সেই স্থানে অবস্থিত।
স্থাপত্য ও মন্দিরের গঠনশৈলী
দ্বারকাধীশ মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী শুধু সুন্দর নয়, বরং শক্তিশালী প্রতীকী তাৎপর্যপূর্ণও। মন্দিরটি চুনাপাথর দিয়ে নির্মিত এবং এর কারুকার্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল। এর শিখর প্রায় ৭৮ মিটার (২৫৬ ফুট) উঁচু এবং এতে পাঁচটি তলা রয়েছে, যা ৭২টি স্তম্ভের উপর স্থাপিত।
মন্দিরের দুটি প্রধান প্রবেশদ্বার রয়েছে:
- মোক্ষ দ্বার (প্রবেশদ্বার)
- স্বর্গ দ্বার (প্রস্থান দ্বার)
স্বর্গ দ্বার থেকে গোমতী নদীর দিকে যাওয়ার জন্য ৫৬টি সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে।
মন্দিরের উপরে ওড়ানো পতাকাও অত্যন্ত বিশেষ। এই পতাকা সূর্য ও চন্দ্রের প্রতীক এবং এর অর্থ হল, যতদিন এই দুটি গ্রহ থাকবে, ততদিন শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি পৃথিবীতে বজায় থাকবে। এই পতাকা ১৫ মিটার লম্বা এবং এটি দিনে চারবার পরিবর্তন করা হয়, যা ভক্তরা বিশেষ দান করে ওড়ানোর সৌভাগ্য লাভ করেন।
দ্বারকা নগরীর ঐতিহাসিক রূপ
গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত দ্বারকা শহরের উল্লেখ মহাভারতে ‘দ্বারকা সাম্রাজ্য’ হিসেবে পাওয়া যায়। এখানে পাওয়া প্রাচীন নোঙর, পাথরের খাঁজের চিহ্ন এবং সমুদ্রের গভীরে নিমজ্জিত কাঠামো এই নগরের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, সমুদ্রের একটি বড়ো প্লাবন একসময় এই প্রাচীন দ্বারকাকে গ্রাস করেছিল, যা বর্তমানে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক ও ভক্তিভাবের সঙ্গে জড়িত ঘটনা
দ্বারকা নগরীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সুপ্রাচীন। এটি গুজরাটের গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত এবং মহাভারতের মতো প্রাচীন গ্রন্থেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বারকাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী হিসেবে মানা হয়। এখানে সমুদ্রের ধারে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেমন পুরনো নোঙর, পাথরের ছিদ্র এবং সমুদ্রের গভীরে ডুবে থাকা স্থাপত্য, যা ইঙ্গিত দেয় যে একসময় এটি সমৃদ্ধ বন্দর ছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, কয়েক হাজার বছর আগে সমুদ্রের একটি বড়ো বন্যায় প্রাচীন দ্বারকা ডুবে গিয়েছিল। এখন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা সমুদ্রের গভীরে গিয়ে এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। এই আবিষ্কারগুলি প্রমাণ করে যে দ্বারকা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ভারতের প্রাচীন ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মন্দিরে দর্শনের সময় ও নিয়মাবলী
দ্বারকাধীশ মন্দির প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯:৩০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভক্তরা মঙ্গলা আরতি, শৃঙ্গার আরতি, রাজভোগ আরতি এবং শয়ন আরতিতে অংশ নিতে পারেন।
দ্বারকাধীশ মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতার একটি দিব্য কেন্দ্র। এই মন্দির সেই যুগের সাক্ষী, যখন ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ একটি সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হত। আজও যখন আপনি দ্বারকার পাথর, গলি এবং মন্দিরের চূড়া দেখেন, তখন সেখানে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিধ্বনি অনুভব করতে পারবেন।