ভারতীয় ক্রিকেটের সেই নাম, যিনি তাঁর স্পিন দিয়ে বিশ্বের নামজাদা ব্যাটসম্যানদের নাচিয়েছিলেন — হরভজন সিং। ৩ জুলাই ১৯৮০ সালে পাঞ্জাবের জালন্ধরে জন্ম নেওয়া হরভজন সিং আজ তাঁর ৪৫তম জন্মদিন পালন করছেন। ক্রিকেট মাঠে তিনি 'টার্বনেটর' নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি ব্যাটসম্যানদের উপর বিদ্যুতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তেন এবং বহুবার ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতেন।
হরভজন সিং ১৯৯৮ সালে ভারতীয় দলে প্রবেশ করেন এবং তারপর ২৩ বছর ধরে ক্রিকেট প্রেমীদের তাঁর বোলিং দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। টেস্ট হোক, ওয়ানডে হোক বা টি২০ — হরভজন প্রতিটি ফর্ম্যাটে টিম ইন্ডিয়াকে অনেক ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছেন।
ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিকের কীর্তি
হরভজন সিংয়ের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সোনালী মুহূর্ত ছিল ২০০১ সালে, যখন ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে কলকাতার ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে খেলা হওয়া টেস্ট ম্যাচটি একটি ঐতিহাসিক গল্প হয়ে যায়। এই ম্যাচে হরভজন সিং লাগাতার তিনটি বলে রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং শেন ওয়ার্নকে আউট করে ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেন। এই মুহূর্তটি ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
শুধু হ্যাটট্রিকই নয়, সেই সিরিজে হরভজন ৩২ উইকেট নিয়ে ভারতের ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তাঁর এই পারফরম্যান্স তাঁকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয় এবং ভারতীয় স্পিন বোলিংয়ের শীর্ষস্থানীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আইপিএলে ৭ম উইকেটের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপের রেকর্ড
হরভজন সিংয়ের পরিচিতি শুধু বোলিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আইপিএলেও তিনি ব্যাট হাতে বহুবার দলকে উদ্ধার করেছেন। ২০১৫ সালে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের (বর্তমানে পাঞ্জাব কিংস) বিরুদ্ধে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলার সময় হরভজন সিং জে সুচিতের সঙ্গে ৭ম উইকেটের জন্য ১০০ রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন। এই পার্টনারশিপ আজও আইপিএলের ইতিহাসে ৭ম উইকেটের জন্য সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ হিসেবে বিবেচিত হয়। হরভজন সেই ইনিংসে ৬৪ রান করেছিলেন, যদিও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স জয়লাভ করতে পারেনি, তবে তাঁর লড়াকু ইনিংস প্রত্যেক ক্রিকেট প্রেমীর মন জয় করে নিয়েছিল।
এমন ছিল হরভজনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন
হরভজন সিং ভারতের হয়ে ১০৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে ৪১৭ উইকেট শিকার করেছেন। তাঁর গড় ছিল ৩২.৪৬ এবং ২৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ব্যাটিংয়েও ভাজ্জি পিছিয়ে ছিলেন না — টেস্টে ২২২৪ রান, যার মধ্যে ২ টি সেঞ্চুরি এবং ৯টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে হরভজন ২৩৬টি ম্যাচে ২৬৯ উইকেট শিকার করেছেন এবং ১২৩৭ রান করেছেন। এছাড়াও টি২০ ইন্টারন্যাশনালে তিনি ২৮টি ম্যাচ খেলে ২৫ উইকেট নিজের নামে করেছেন।
আইপিএলেও হরভজন ১৬৩ ম্যাচে ১৫০ উইকেট নিয়ে তাঁর উপযোগিতা প্রমাণ করেছেন। ৮৩৩ রান করে তিনি দেখিয়েছেন যে কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি দলের জন্য একজন অলরাউন্ডারের ভূমিকা পালন করতে পারেন।
দুটি বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন
হরভজন সিংয়ের কৃতিত্বের কথা বলতে গেলে, তিনি ২০০৭ সালে ভারতের প্রথম টি২০ বিশ্বকাপ জয়ী দল এবং ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। ২০১১ সালে তাঁর স্পিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ভারতকে জয় এনে দেয় এবং যুবরাজ সিং, জহির খানের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিলে দলকে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ জেতাতে অবদান রাখেন।
হরভজন সিংয়ের ক্রিকেট যাত্রা বর্তমান তরুণদের শিক্ষা দেয় যে, আবেগ এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সবকিছু সম্ভব। কঠিন সময়ে তাঁর সাহস, আগ্রাসন এবং মাঠের শক্তিশালী উপস্থিতি সবসময় স্মরণ করা হবে। যদিও আজ হরভজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন, তবে ধারাভাষ্য এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তিনি ভক্তদের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং ক্রিকেটের জগতে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন।
হরভজন সিংকে তাঁর ৪৫তম জন্মদিনে কোটি কোটি ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীর পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা। তাঁর যাত্রা আগামী প্রজন্মকে সবসময় অনুপ্রাণিত করবে।