হেমু বিক্রমাদিত্য: হিন্দুস্তানের সিংহাসনে এক বিস্মৃত বীর

হেমু বিক্রমাদিত্য: হিন্দুস্তানের সিংহাসনে এক বিস্মৃত বীর

ভারতীয় ইতিহাসে এমন অনেক যোদ্ধা আছেন যাদের সাহস এবং নেতৃত্ব দক্ষতা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। কিন্তু এমন কিছু মানুষও আছেন যাদের অবদান ইতিহাসের মূল স্রোতে আসতে পারেনি, যাদের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দেওয়া হয়েছে। এমনই একটি নাম — হেমচন্দ্র ওরফে হেমু বিক্রমাদিত্য, যিনি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে হিন্দুস্তানের সিংহাসনে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের একটি সামান্য ভুলে তিনি ইতিহাসে ‘প্রায় সম্রাট হতে না পারা একজন’ হয়ে রয়ে গেছেন।

প্রাথমিক জীবন: সাধারণ শুরু থেকে বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা

হেমুর জন্ম একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে, যারা আজকের হরিয়ানার রেওয়াড়ি অঞ্চলে বসবাস করত। পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকায় হেমুকে ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিল। কিছু ইতিহাসবিদের মতে, তিনি লবণ বিক্রি বা ওজন করার কাজ করতেন। এটি ছিল সেই সময় যখন মুঘল এবং আফগান শক্তি উত্তর ভারতে আধিপত্যের জন্য সংঘর্ষ চালাচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতেই হেমু তার ভেতরের নেতৃত্ব দক্ষতাকে শাণিত করেছিলেন।

প্রশাসন থেকে যুদ্ধ নীতি: অনন্য প্রতিভার বিস্তার

হেমু আফগান শাসনের অধীনে ইসলাম শাহ সুরীর দরবারে কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি দিল্লির বাজার তত্ত্বাবধায়ক হন, পরে তাকে ডাক ও গুপ্তচর বিভাগের প্রধানও করা হয়। তার সামরিক জ্ঞান দেখে আদিল শাহ সুরি তাকে সেনাপতি করেন এবং পরবর্তীতে তিনি রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীও হন। এখন তিনি কেবল একজন প্রশাসক নন, একজন যোদ্ধাও হয়ে উঠেছিলেন।

২২টি বিজয়ী যুদ্ধ: একের পর এক সাফল্য

ইতিহাসে এটা উল্লেখ আছে যে হেমু আদিল শাহের পক্ষে ২২টি যুদ্ধ লড়েছিলেন এবং জিতেছিলেন। এর মধ্যে অনেক যুদ্ধ ছিল আফগান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে, আবার কিছু যুদ্ধে তিনি মুঘল সেনাদেরও পরাজিত করেছিলেন। ছিবরামউ এবং চুনারের মতো জায়গায় তাজ খান কররানির মতো বিদ্রোহীদের পরাজিত করা ছিল তার সামরিক কৌশলের প্রমাণ। তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দিল্লি বিজয় এবং বিক্রমাদিত্যের উপাধি

হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে দিল্লি ও আগ্রার অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হেমু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলা থেকে দ্রুত যাত্রা করে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। তিনি তুঘলকাবাদের যুদ্ধে মুঘলদের পরাজিত করে ১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবর দিল্লি দখল করেন। এরপর তিনি 'বিক্রমাদিত্য' উপাধি ধারণ করেন, যা ভারতীয় ইতিহাসে হিন্দু সম্রাটদের গৌরব হিসেবে বিবেচিত হত। এই মুহূর্তটি ছিল তার জীবনযাত্রার সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্ত।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: একটি তীর যা ইতিহাস বদলে দিয়েছিল

হেমুর দিল্লি বিজয়ের পর মুঘলদের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র এবং निर्णायक। ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হেমু তার বিখ্যাত যুদ্ধ-হাতি ‘হাওয়াই’তে চড়ে নিজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যুদ্ধ প্রায় জয়ের কাছাকাছি ছিল, ঠিক তখনই একটি তীর তার চোখে এসে লাগে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সৈন্যরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং পরাজয় ঘটে। তাকে বন্দী করা হয় এবং আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান তাকে হত্যা করেন।

ফলাফল এবং উত্তরাধিকার: একটি অসম্পূর্ণ বিপ্লবের প্রতিধ্বনি

হেমুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু শাসক হিসেবে একটি মহান প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটে। তার পরিবারকে বন্দী করা হয়; তার বাবা ধর্ম পরিবর্তনে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়, কিন্তু তার স্ত্রী পালিয়ে যান। পানিপথের যুদ্ধে পাওয়া ১২০টি হাতি মুঘল সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে এটি তাদের কৌশলের অংশ হয়ে ওঠে। রেওয়াড়িতে আজও হেমুর সমাধি রয়েছে, যা তার অদম্য সাহসের সাক্ষ্য বহন করে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে সেদিন যদি তীরটি না লাগত, তবে ভারতে একজন ব্রাহ্মণ সম্রাটের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারত — যা একটি হিন্দু পুনর্জাগরণের সূচনা করত।

সমালোচনা এবং প্রশংসা: বীরত্বের পেছনের গল্প

মুঘল দরবারের ঐতিহাসিক আবুল-ফজল এবং বদাউনির মতো ব্যক্তিরা হেমুর অবদানকে সীমিত করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার সাহসিকতা, নেতৃত্ব এবং দূরদর্শিতার প্রশংসা না করে তারা থাকতে পারেননি। আবুল-ফজল লিখেছেন, 'যদি আকবর তাকে হত্যা না করে রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করত, তবে সে অবশ্যই তার প্রতিভা দিয়ে দরবারে উজ্জ্বলতা ছড়াত।'

হেমু বিক্রমাদিত্য ভারতীয় ইতিহাসের এমন একটি মুখ যিনি পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাননি। একজন সাধারণ লবণ ব্যবসায়ী থেকে ভারতের সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন তিনি সত্যি করে দেখিয়েছিলেন। যদি ভাগ্যের একটি তীর তার চোখে না লাগত, তবে আজ ভারতীয় ইতিহাসে মুঘল ও ইংরেজদের মাঝে একটি হিন্দু রাজত্বের স্বর্ণালী ইতিহাস লেখা থাকত।

Leave a comment