ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা পড়ল গিল-বাহিনীর নাম
পঞ্চম টেস্টে জয়, আর তার হাত ধরেই ৭৭ বছরের খরা কাটিয়ে অবশেষে পাঁচ ম্যাচের বিদেশ সফরের শেষ টেস্ট জয়ের স্বাদ পেল ভারত। এর আগে কখনও বিদেশের মাটিতে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচ জিততে পারেনি টিম ইন্ডিয়া। ১৬ বার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু প্রতিবারই হাতছাড়া হয়েছিল ইতিহাস লেখার সুযোগ। তবে এবার ওভালের সেই শেষ দিনে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে ইতিহাস লিখল শুভমন গিলের টিম ইন্ডিয়া।
শেষ দিনে নাটকীয় রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে সিরাজের দুর্দান্ত কামব্যাক
সোমবার টেস্টের পঞ্চম দিন সকালে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৫ রান, হাতে ছিল ৪ উইকেট। মনে হচ্ছিল, ব্রিটিশরা সহজেই সিরিজ ৩-১ করে ফেলবে। কিন্তু ভারতের পেসার মহম্মদ সিরাজ যেন চূড়ান্ত নাটকীয়তা এনেই হাজির হলেন। একার হাতে ৩টি উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন তিনি। আর শেষ উইকেটটা পড়ে মাত্র ৫৭ মিনিটে, গাস অ্যাটকিনসনের স্টাম্প উড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের উল্লাসে ফেটে পড়া — যেন ক্রিকেট ঈশ্বররাও ইতিহাস লেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন!
‘সিরাজ ঝড়ে’ উড়ে গেল ব্রিটিশরা, জয় এনে দিলেন বল হাতে
গাস অ্যাটকিনসনকে বোল্ড করেই সিরিজ়ের পর্দা ফেলেন সিরাজ। দু’হাত ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়া সিরাজের সেই ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল। তাঁকে জড়িয়ে ধরতে ছুটে আসেন দলের বাকি সদস্যরা। একে একে উইকেট তুলে নেন, বুক চিতিয়ে লড়ে যান। সিরাজ যে এই ঐতিহাসিক ড্রয়ের অন্যতম নায়ক — তা বলাই বাহুল্য। গোটা সিরিজে ২৩ উইকেট নিয়ে সিরিজ়ের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিও তিনিই।
প্রসিধ কৃষ্ণও পেস আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন
সিরিজ়ের শেষ দিনে ভারতীয় পেস আক্রমণের আরেক উজ্জ্বল মুখ ছিলেন প্রসিধ কৃষ্ণ। তিনি শেষ উইকেটটি ছাড়া বাকি ৮টি উইকেট জুড়ে ছিলেন সিরাজের ছায়া হয়ে। তবে এই টেস্টে তিনি নিজেও ৮টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেন। বিশেষত এই ওভাল টেস্টে ভারতীয় পেসারদের সাফল্যই ভারতকে সিরিজ় ড্র করানোর পথে এগিয়ে দেয়। স্পিন-নির্ভর ভারতীয় বোলিং নয়, পেস আক্রমণেই ইতিহাস লেখা — এই দৃষ্টান্ত এক কথায় অবিশ্বাস্য।
১-২ পিছিয়ে থেকেও সিরিজ় ড্র করার নজির, ভারতের প্রথম
এই সিরিজ়ের আগে বিদেশে কোনও পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ়ে ১-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে আর ফিরে আসতে পারেনি ভারত। এবার প্রথম বারের মতো সেই ব্যতিক্রম ঘটল। শেষ টেস্ট জিতে সিরিজ় ২-২ করে ড্র করল টিম ইন্ডিয়া। এমনকি, ভারতের পক্ষে টেস্ট ইতিহাসে এটি সবচেয়ে ছোট ব্যবধানের জয় — মাত্র ৩১ রানে ম্যাচ জেতা। ভারতীয় ক্রিকেটে এটি একটি ‘মার্কার মোমেন্ট’ হয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা।
সিরিজ় জুড়ে সিরাজের অবিশ্বাস্য ফর্ম, একা খেলেছেন সব ম্যাচ
ম্যাচের শেষে যা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট সিরিজের রাজা হলেন মহম্মদ সিরাজ। প্রায় ১২০০ বল করেছেন, নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২৩টি উইকেট। সিরিজে দু’দলের মধ্যে একমাত্র পেসার যিনি পাঁচটি টেস্টই খেলেছেন এবং প্রতিটি ম্যাচেই দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে এত বড় সিরিজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যে কতটা কষ্টসাধ্য, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন সিরাজ।
ওভাল টেস্টে ব্যাট-বলে সম্মিলিত লড়াই, ভারতের জয়ের চাবিকাঠি
এই ঐতিহাসিক জয় শুধুই বোলারদের নয়, ব্যাটারদেরও কৃতিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে প্রথম ইনিংসে ভারতের মিডল অর্ডার ব্যাটাররা দলকে সম্মানজনক স্কোর এনে দেন। ওভালের উইকেটে যেমন বল ঘুরছিল, তেমনই বাউন্স থাকায় ব্যাটারদের জন্য ম্যাচটা ছিল কঠিনতম। কিন্তু গিল, ঈশান, সূর্যরা ধারাবাহিকভাবে রান করে দলের ভিত গড়ে দেন। সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই সিরাজ-প্রসিধদের পেস তোপ ম্যাচ জয়ের পথে নিয়ে যায়।
শুধু জয় নয়, আত্মবিশ্বাসে ফের ভারতের দাপট ফিরল টেস্ট ক্রিকেটে
এই জয় শুধুমাত্র একটি ম্যাচ জেতার ঘটনা নয়, এটি ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের মনস্তত্ত্ব বদলে দিতে পারে। বিদেশের মাটিতে পাঁচ ম্যাচের লম্বা সিরিজ় খেলতে নামা, এবং মাঝপথে পিছিয়ে থেকেও সিরিজ় ড্র করা — এক কথায় অনন্য। ভারতীয় ক্রিকেট দলের চরিত্রে যে আগ্রাসন ও ধৈর্যের যুগলবন্দি এখন ফুটে উঠছে, এই সিরিজ় তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।