ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম’ তার ১৫০ বছর পূর্ণ করছে। ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এই গান স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন শক্তি জুগিয়েছিল। আজও এই গান দেশপ্রেম, ঐক্য এবং মাতৃভূমির প্রতি আত্মনিবেদনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
Vande Mataram 150 Years: ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম’ আজ তার ১৫০ বছর পূর্ণ করছে। ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এটি রচনা করেছিলেন, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এই গান পরাধীনতার সময়কালে ভারতীয়দের মনে আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার অনুভূতি জাগিয়েছিল। এই ঐতিহাসিক উপলক্ষে কেন্দ্র সরকার দেশজুড়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে, যাতে নতুন প্রজন্মকে বন্দে মাতরমের গুরুত্ব এবং এর প্রেরণাদায়ক যাত্রার সঙ্গে যুক্ত করা যায়।
স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর হলো ‘বন্দে মাতরম’
‘বন্দে মাতরম’ প্রথম ১৮৭৫ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আনন্দমঠ’-এ এটিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই গানটিকে সুরে বাঁধার কাজটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৯৬ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে এই গানটি প্রথম জনসমক্ষে গাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই গান স্বাধীনতার স্লোগান হয়ে ওঠে।
মানুষ রাস্তায় নেমে "বন্দে মাতরম" ধ্বনি দিয়ে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে। স্কুল ও কলেজে যখন এই গান গাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তখনও শিক্ষার্থীরা এটি গাইতে থাকে। এই সময়ে ‘বন্দে মাতরম’ প্রতিটি ভারতীয়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল।
উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এ ভারতমাতার প্রতীকী চিত্র
‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্ন্যাসীদের একটি দল ‘মা ভারতী’র সেবাকেই সর্বোচ্চ ধর্ম বলে মনে করে। উপন্যাসে মায়ের তিনটি মূর্তি ভারতের তিনটি রূপকে দেখায়—অতীতের গৌরবময়ী মাতা, বর্তমানের পীড়িতা মাতা এবং ভবিষ্যতের পুনরুজ্জীবিতা মাতা। অরবিন্দ লিখেছিলেন যে এই মা “ভিক্ষার পাত্র নিয়ে নয়, বরং সত্তর কোটি হাতে তরবারি ধারণ করা ভারতমাতা”।"
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: দেশপ্রেমের প্রেরণা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪) বাংলার এক মহান সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ‘दुर्गेशनंदिनी’, ‘কপালকুণ্ডলা’ এবং ‘দেবী চৌধুরানী’-র মতো রচনার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদার অনুভূতি জাগিয়েছিলেন। ‘বন্দে মাতরম’-এর মাধ্যমে তিনি এই বার্তা দিয়েছিলেন যে মাতৃভূমিই সর্বোচ্চ দেবী। এই গানটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাগত ভিত্তি তৈরি করেছিল।

বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণার উৎস হলো এই গান
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ‘বন্দে মাতরম’ প্রতিটি আন্দোলনের প্রাণ হয়ে উঠেছিল। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে ভিকাজী কামা যখন ভারতের প্রথম তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন, তাতে ‘বন্দে মাতরম’ লেখা ছিল। ইংল্যান্ডে ফাঁসির আগে মদনলাল ধিংরার শেষ শব্দগুলিও এটাই ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় গোপালকৃষ্ণ গোখলের অভ্যর্থনাতেও এই গান ধ্বনিত হয়েছিল। এই গান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হৃদয়ে সাহস ও আত্মনিবেদনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এভাবে হলো জাতীয় সঙ্গীত
১৯৫০ সালে সংবিধান সভা সর্বসম্মতিক্রমে ‘বন্দে মাতরম’-কে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করে। সংবিধান সভার সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামে এই গানের ঐতিহাসিক ভূমিকা বিবেচনা করে এটিকে ‘জন গণ মন’-এর সমান সম্মান দেওয়া হবে। তখন থেকে এই গান দেশের ঐক্য এবং জাতীয় গৌরবের প্রতীক হয়ে আছে।
দেশজুড়ে ১৫০ বছরের উৎসব
এই বছর কেন্দ্র সরকার ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় জমকালো অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেছে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামে জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে, যখন জেলা ও মহকুমা স্তরে বিশেষ আয়োজন করা হবে। ডাকটিকিট, স্মারক মুদ্রা এবং ‘বন্দে মাতরম’ ভিত্তিক প্রদর্শনীও জারি করা হবে। অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শন এই উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
বৈশ্বিক স্তরেও সম্মান
ভারতের সকল দূতাবাস ও মিশনে ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হবে। Vande Mataram: Salute to Mother Earth থিমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সঙ্গীত উৎসব এবং বৃক্ষরোপণ অভিযান চলবে। দেওয়ালে ম্যুরাল এঁকে যুবকদের এই বার্তা দেওয়া হবে যে মাতৃভূমির সেবাই সত্যিকারের দেশপ্রেম।
অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত
১৫০ বছর পরেও ‘বন্দে মাতরম’ প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। এই গান কেবল ইতিহাস নয়, বরং অনুপ্রেরণার উৎস। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের শক্তি তার ঐক্য ও সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত এবং এই অনুভূতি আগামী প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগাতে থাকবে।












