শ্রাবণ মাস শুরু হতেই উত্তর ভারত জুড়ে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, দিল্লি এবং রাজস্থানে শিবভক্তরা কাঁওয়ার যাত্রা শুরু করেন। এই ভক্তরা, যাদের সাধারণত 'কাঁওয়ারিয়া' বলা হয়, পবিত্র গঙ্গাজল এনে তাদের স্থানীয় শিবমন্দিরে নিবেদন করেন।
গঙ্গাজল আনার জন্য তারা শত শত কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যান এবং সারা পথ 'বল বম' ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন। কিন্তু এই পুরো ধর্মীয় অভিযানের শিকড় কোন পৌরাণিক কাহিনিতে লুকানো আছে, সেই প্রশ্ন সবসময়ই থেকে যায়।
ভগবান পরশুরাম কি প্রথম কাঁওয়ার যাত্রা করেছিলেন?
অনেক পুরোনো কাহিনি এবং লোকশ্রুতিতে বলা হয়েছে যে, সর্বপ্রথম ভগবান পরশুরাম কাঁওয়ার যাত্রা করেছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি গড়মুক্তেশ্বর থেকে পবিত্র গঙ্গাজল ভরে বাঘপতের 'পুরা মহাদেব' মন্দিরে ভগবান শিবের জলাভিষেক করেছিলেন।
এই যাত্রা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভক্তি থেকে শুরু হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবর্তিত হয়। পরশুরামকে শিবের পরম ভক্ত হিসেবে মানা হয়, এবং সেই কারণে তাঁর নাম এই ঐতিহ্যের শুরুর সঙ্গে যুক্ত করা একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত দেয়।
রামায়ণকালেও কাঁওয়ার যাত্রার ঝলক দেখা যায়
অন্য একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্রও এই পবিত্র যাত্রা করেছিলেন। কথিত আছে যে তিনি বিহারের সুলতানগঞ্জ থেকে গঙ্গাজল নিয়ে ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে অবস্থিত বাবা বৈদ্যনাথ ধামে শিবলিঙ্গের ওপর জল ঢেলেছিলেন।
এই যাত্রা তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, কারণ স্বয়ং ভগবান রাম শিবভক্তির এই মাধ্যমটিকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এই কাজ আজও অনেক ভক্ত তাদের কাঁওয়ার যাত্রার সময় পুনরাবৃত্তি করেন।
রাবণ ও শিবের কাহিনির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই পরম্পরা
অন্য একটি প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, রাবণও কাঁওয়ার যাত্রা করেছিলেন। যখন সমুদ্র মন্থনের পর ভগবান শিব বিষ পান করে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গিয়েছিল, তখন রাবণ তাঁকে শীতল জল দিয়ে শান্ত করার জন্য কাঁওয়ারে জল ভরে 'পুরা মহাদেব' মন্দিরে গিয়ে জলাভিষেক করেছিলেন।
রাবণকে শিবের পরম ভক্ত হিসেবে মানা হয়, এবং তাঁর এই কাজকে কাঁওয়ার যাত্রার শুরু হিসেবে দেখা হয়। এরপর এই পরম্পরা বিভিন্ন যুগে ভক্তদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে।
দেবতাদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই যাত্রার কাহিনি
কিছু বিশ্বাস অনুযায়ী, যখন ভগবান শিব সমুদ্র মন্থন থেকে ওঠা বিষ পান করেন এবং তাঁর শরীর জ্বলতে শুরু করে, তখন সকল দেবতারা তাঁকে শান্ত করার জন্য পবিত্র নদীর জল নিবেদন করেছিলেন। এই ঘটনাকেও কাঁওয়ার যাত্রার শুরু হিসেবে দেখা হয়, কারণ এটাই ছিল সেই সময় যখন জল দিয়ে শিবের আরাধনা করার পরম্পরা শুরু হয়েছিল।
কাঁওয়ার কাঁধে রাখার পেছনে কী ভাবনা রয়েছে?
কাঁওয়ার যাত্রার সময় একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় - গঙ্গাজল ভর্তি কাঁওয়ার কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া। এর পেছনে শুধু ধর্মীয় নিয়ম নয়, গভীর আধ্যাত্মিক ভাবনাও জড়িত রয়েছে।
বলা হয় যে এটি নিজের অহংকার ত্যাগ করার প্রতীক। যখন কোনো ভক্ত সম্পূর্ণ বিনম্রভাবে পবিত্র জল নিজের কাঁধে বহন করেন, তখন তিনি তাঁর ভেতরের অহংবোধকে পরিত্যাগ করেন এবং সেবা ও শ্রদ্ধার ভাবনায় ডুবে যান।
শ্রবণ কুমারের উদাহরণ এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক – তিনি তাঁর বাবা-মাকে কাঁওয়ারে বসিয়ে তীর্থ যাত্রা করিয়েছিলেন। সেই সেবা ও আত্মনিবেদনের ভাবনা আজও কাঁওয়ার যাত্রার মূল ভিত্তি।
আজও জীবন্ত এই প্রাচীন পরম্পরা
হাজার হাজার বছর পুরোনো এই পরম্পরা আজও নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধা ভরে পালন করে চলেছে। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত দেশের নানা প্রান্ত থেকে গঙ্গাজল নেওয়ার জন্য হরিদ্বার, গঙ্গোত্রী, সুলতানগঞ্জ, গৌমুখের মতো স্থানে যান এবং সেখান থেকে জল নিয়ে এসে নিজেদের গ্রাম-শহরের শিবমন্দিরে নিবেদন করেন।
যাত্রার সময় তারা খালি পায়ে, উপোস থেকে এবং নিয়মকানুন মেনে চলেন। রাস্তার ধারে সেবাদাররা তাদের খাবার, ওষুধ, বিশ্রাম এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা করে থাকেন। এটা শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং পুরো সমাজের মিলিত বিশ্বাসের উৎসবে পরিণত হয়েছে।