রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী দিবসের সরকারি মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাষায় জানান, মেয়েদের মধ্যে স্কুল ড্রপ আউট উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হওয়ার ফলে আরও বেশি সংখ্যক মেয়ে নিয়মিত স্কুলে পড়াশোনা করছে এবং শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে।
পরিসংখ্যানের ভাষায় সাফল্য
মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেন ২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪-এর পরিসংখ্যান। প্রাইমারিতে মেয়েদের ড্রপ আউট ৩.৬০% থেকে নেমে এসেছে শূন্যে। আপার প্রাইমারিতেও ৪.৫৭% থেকে শূন্য শতাংশে নেমেছে এই হার। সেকেন্ডারিতে যেখানে আগে ছিল ১৬.৩২% ড্রপ আউট, তা এখন ২.৯%। হায়ার সেকেন্ডারিতে ১৫.৪১% থেকে কমে হয়েছে ৩.১৭%। এই তথ্য মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও মেয়েদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফল’।
১ কোটি ছাত্রী লক্ষ্যপূরণের পথে
এখন কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুরক্ষাকবচে যুক্ত প্রায় ৯৩ লক্ষ ছাত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, খুব শিগগিরই এই সংখ্যা ১ কোটির গণ্ডি ছুঁলে গোটা রাজ্যে হবে বিশেষ উৎসব। রাজনৈতিক মহলের হিসাব, বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে এই সাফল্যের বার্তা রাজ্যের নারীদের মনে ইতিবাচক স্রোত বইয়ে দিতে পারে।
সমালোচকদের পাল্টা প্রশ্ন
তবে সামাজিক আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ এই দাবিকে আংশিক প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাঁর মতে, শুধুমাত্র স্কুলে নাম নথিভুক্ত করলেই শিক্ষার মান নির্ধারিত হয় না। তিনি ইউনিসেফের তথ্যের উল্লেখ করে বলেন, নাবালিকা মাতৃত্বের হারে পশ্চিমবঙ্গ এখনও সারা দেশে শীর্ষে। অর্থাৎ অনেক ছাত্রী স্কুলে নাম লিখিয়ে প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে না বা পরীক্ষায় বসছে না—এই বাস্তবতা নিয়ে কোনও গবেষণা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
শিক্ষার বাইরে মানসিক স্বাস্থ্যের বার্তা
কন্যাশ্রী দিবসের পাশাপাশি বেহালায় স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী স্কুলছাত্রীদের মানসিক চাপ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্য, এখনকার শিশুরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণে ব্যস্ত, তাদের শৈশবের অবসর সময় হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
শৈশব ফেরানোর আহ্বান
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাবা-মায়েদের উদ্দেশে বলেন, "শিশুমন বোঝা খুব জরুরি। সন্তান যদি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, তার সঙ্গে কথা বলুন, দেখবেন সে হালকা হয়ে যাবে।" তাঁর মতে, শুধু পরীক্ষার ফল বা পড়াশোনায় ভালো করা নয়, মানসিক বিকাশও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, কন্যাশ্রী প্রকল্প রাজ্য সরকারের অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এই প্রকল্প মেয়েদের শিক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও সমালোচনার জায়গাগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করা গেলে এর প্রভাব আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিশেষত, ভোটের আগে এই সাফল্যের প্রচার রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিতে পারে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রপ আউটের হার শূন্যে নামিয়ে আনা একটি বড় সাফল্য হলেও, এখন প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা ও বাস্তব উপস্থিতি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, নাবালিকা মাতৃত্ব, পুষ্টিহীনতা ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো সমানভাবে মোকাবিলা করাই হবে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ।