কাওড় যাত্রা: প্রকারভেদ ও ধর্মীয় গুরুত্ব

কাওড় যাত্রা: প্রকারভেদ ও ধর্মীয় গুরুত্ব

শ্রাবণ মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিব ভক্তদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায়। এই সময়টা হল ভগবান শিবের ভক্তি ও জলাভিষেকের। প্রতি বছর শ্রাবণ মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার কাওড়িয়া (কাওড় বহনকারী) গঙ্গা জল নিতে বের হন এবং তা নিজ নিজ শহরের শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের উপর অর্পণ করেন।

২০২৫ সালে শ্রাবণ মাসের শুরু হচ্ছে ১১ই জুলাই থেকে, এবং এই দিন থেকেই কাওড় যাত্রা (কাওড় বহন করে তীর্থযাত্রা) শুরু হবে। এই যাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং এটি আস্থা, তপস্যা এবং সমর্পণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এতে ভক্তগণ বহু দিন ধরে কঠিন যাত্রা করেন। তবে খুব কম লোকই জানেন যে কাওড় যাত্রা এক প্রকারের হয় না, বরং এর চারটি প্রধান রূপ রয়েছে।

সাধারণ কাওড় যাত্রা – সবচেয়ে প্রচলিত কিন্তু সুশৃঙ্খল যাত্রা

সাধারণ কাওড় যাত্রা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এতে ভক্তরা গঙ্গা জল নিতে যান এবং কোনো তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে শিবধামের দিকে এগিয়ে যান। পথে বিশ্রামও করেন, কিন্তু নিয়ম থাকে যে গঙ্গা জলপূর্ণ কাওড় (বাঁশের বহনযোগ্য কাঠামো) মাটিতে রাখা যাবে না। এই যাত্রা সাধারণ ভক্তদের জন্য, যারা জীবনে প্রথমবার কাওড় যাত্রা করছেন।

ডাক কাওড় – অবিরাম শিবের চরণের দিকে

ডাক কাওড় যাত্রাকে সবচেয়ে দ্রুত এবং তীব্র যাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে ভক্তরা গঙ্গা জল নিয়ে অবিরাম চলতে থাকেন। অনেক সময় এই যাত্রা দিন-রাত চলতে থাকে। এই যাত্রায় যে ভক্তরা দৌড়ে জল নিয়ে পৌঁছান, তারা এটিকে একটি মিশনের মতো গ্রহণ করেন এবং শিবলিঙ্গের উপর জল অর্পণ করার পরেই বিশ্রাম করেন।

এই যাত্রায় একটি পুরো দল থাকে, যেখানে অনেক সহযোগী তাদের সঙ্গে থাকে। জল বহনকারী প্রধান কাওড়িয়া কখনও থামেন না। তাঁর সাহায্যের জন্য দলের অন্য সদস্যরা তাঁকে খাবার, জল বা প্রয়োজনীয় সহায়তা সরবরাহ করেন।

খড়ি কাওড় – নামানো নিষেধ, সহায়ক সঙ্গী

খড়ি কাওড় যাত্রা সেই ভক্তদের জন্য, যারা শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে বিশেষভাবে এই নিয়ম পালন করেন যে পুরো যাত্রাপথে কাওড় কখনও মাটিতে রাখা হবে না। এই যাত্রায় কাওড়িয়ার সঙ্গে এক বা দুইজন সহযোগী থাকেন, যারা প্রয়োজন হলে কাওড়টি ধরে রাখেন, যাতে ভক্ত বিশ্রাম নিতে পারেন। এতে যাত্রা কিছুটা দীর্ঘ হতে পারে, তবে এতে শৃঙ্খলার বিশেষ পালন করা হয়।

দাঁড়ি কাওড় – সবচেয়ে কঠিন কিন্তু সবচেয়ে পুণ্যদায়ী

দাঁড়ি কাওড় যাত্রাকে সবচেয়ে কঠিন হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে ভক্তরা দণ্ডবৎ করতে করতে এগিয়ে যান। অর্থাৎ, দু’হাত সামনে রেখে শুয়ে পড়েন, তারপর সেখান থেকে উঠে আবার দু’কদম এগিয়ে যান। এই প্রক্রিয়া পুরো যাত্রায় পুনরাবৃত্তি করা হয়।

এই যাত্রা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও খুব কঠিন। এতে ভক্ত নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ভোলানাথের চরণে সমর্পণ করেন। এতে অনেক বেশি সময় লাগে, তবে শ্রদ্ধা ও সংকল্পের কারণে এটি কিছু বিশেষ ভক্তই পালন করতে পারেন।

কাওড় যাত্রার ধর্মীয় গুরুত্ব

কাওড় যাত্রার প্রথা সমুদ্র মন্থন থেকে জড়িত। যখন ভগবান শিব হলাহল বিষ পান করেছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গিয়েছিল। বিষের প্রভাব কমাতে দেবতারা তাঁর শিবলিঙ্গের উপর গঙ্গা জল অর্পণ করেছিলেন। সেই প্রথা আজও শিব ভক্তরা পালন করেন এবং গঙ্গা জল নিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করেন।

কাওড়িয়ারা হরিদ্বার, গঙ্গোত্রী, ঋষিকেশ, দেওঘর, গয়া, সুলতানগঞ্জ-এর মতো পবিত্র স্থান থেকে জল নিয়ে আসেন। এই সময়ে তাঁরা সাদা পোশাক পরিধান করেন, জয়ধ্বনি দেন এবং “বোল বম” ধ্বনি দিয়ে পরিবেশকে শিবময় করে তোলেন।

ভক্তদের অনুভূতি কাওড় যাত্রাকে করে তোলে অসাধারণ

প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কাওড়িয়া রাস্তায় দেখা যায়। এদের মধ্যে যুবক, বৃদ্ধ, মহিলা এবং শিশু সকলেই অন্তর্ভুক্ত থাকে। কেউ সাইকেলে, কেউ হেঁটে এবং কেউ ট্রাকে করে যাত্রা করেন। কিন্তু সকলের মনে একটাই উদ্দেশ্য – গঙ্গা জল দিয়ে ভোলানাথের জলাভিষেক করা।

এই যাত্রাগুলোতে নিরাপত্তা, মেডিকেল ক্যাম্প, খাদ্য এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা করা হয়।

Leave a comment