তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের আত্মা এবং পরিচয়ের প্রতীক, দলাই লামার পরম্পরা বর্তমানে এক ঐতিহাসিক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথাগতভাবে, দলাই লামার নির্বাচন, বর্তমান লামার দেহত্যাগের পর, তাঁর পুনর্জন্মের ধারণার ওপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে।
কে হবেন দলাই লামার উত্তরসূরি: বিশ্বে শান্তি, করুণা এবং অহিংসার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ১৪তম দলাই লামা, তেনজিন গ्यातসো, ৬ই জুলাই, ২০২৫ তারিখে তাঁর ৯০তম জন্মদিনে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা করতে পারেন। এই বিষয়ে শুধু তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায় নয়, ভারত, চীন এবং আমেরিকার মতো দেশগুলিও আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আসলে প্রশ্ন হল — কে হবেন ১৫তম দলাই লামা?
এটি কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেরও একটি অংশ হয়ে উঠেছে। প্রথা অনুযায়ী, দলাই লামার দেহত্যাগের পরেই তাঁর পুনর্জন্ম খুঁজে বের করা হয়, কিন্তু ১৪তম দলাই লামা চীনের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের কারণে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর উত্তরসূরীর ঘোষণা করতে পারেন।
দলাই লামার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
দলাই লামা, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের গেলুগ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে গণ্য হন। তিনি করুণার বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের অবতার বলেও পরিচিত। এই উপাধিটি ১৬শ শতাব্দীতে মঙ্গোল শাসক আলতান খান তৃতীয় দলাই লামা সোনম গ্য়াতসোকে দিয়েছিলেন। ১৭শ শতাব্দীতে পঞ্চম দলাই লামা গ্যাদেন ফোদরাং সরকার গঠন করে তিব্বতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একত্রিত করেন।
১৯৫৯ সালে যখন চীন তিব্বত দখল করে, তখন ১৪তম দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নিয়ে ধর্মশালায় আসেন এবং এখান থেকেই নির্বাসিত তিব্বতি প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি শান্তি ও অহিংসার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হন, যা তাঁকে বিশ্বব্যাপী একজন প্রভাবশালী নেতা করে তোলে।
উত্তরসূরীর চ্যালেঞ্জ
প্রথাগতভাবে, দলাই লামার নির্বাচন তাঁর দেহত্যাগের পর পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। প্রবীণ লামাদের একটি কমিটি সম্ভাব্য শিশুদের অনুসন্ধান করে, যারা পূর্ববর্তী দলাই লামার জিনিসপত্র চিহ্নিত করে নিজেদের প্রামাণ্যতা প্রমাণ করে। কিন্তু এবার গল্পটা একটু আলাদা। চীন বেশ কয়েকবার ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ১৫তম দলাই লামা নির্বাচন করবে, যেমনটা তারা ১৯৯৫ সালে পঞ্চেন লামার ক্ষেত্রে করেছিল। ১৪তম দলাই লামা এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে স্পষ্ট করেছেন যে চীনের নির্বাচিত কোনো উত্তরসূরি অবৈধ হবে।
তিনি বলেছেন যে পরবর্তী দলাই লামা চীনের দখলে থাকা তিব্বতে নয়, বরং “স্বাধীন বিশ্বে” জন্ম নেবেন — অর্থাৎ ভারত, হিমালয় অঞ্চল বা লাদাখের মতো স্থানে। সেই সঙ্গে, তিনি এও বলেছেন যে প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই উত্তরসূরী নির্বাচন করবেন।
গ্যাদেন ফোদরাং ট্রাস্টের দায়িত্ব
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্যাদেন ফোদরাং ট্রাস্টকে এই পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ট্রাস্ট প্রবীণ তিব্বতি লামা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সহায়তায় পুনর্জন্ম চিহ্নিত করবে, যাতে চীনের হস্তক্ষেপ এড়ানো যায়। দলাই লামা বলেছেন যে “উদ্ভব” (Emanation) পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে, যেখানে জীবিত থাকাকালীন সময়েই পরবর্তী অবতারের ঘোষণা করা হয়। এই পদ্ধতি চীনের জন্য একটি বড় ধাক্কা হবে, কারণ তখন তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চাপিয়ে দিতে পারবে না।
চীনের কৌশল এবং বিতর্ক
চীন ১৭৯৩ সালের ‘গোল্ডেন আর্ন’ পদ্ধতির উল্লেখ করে দাবি করেছে যে দলাই লামার অনুমোদন দেওয়ার চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদের হাতেই রয়েছে। কিন্তু তিব্বতি সম্প্রদায় এবং বর্তমান দলাই লামা এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর আঘাত হিসেবে মনে করেন। ১৯৯৫ সালে পঞ্চেন লামার ক্ষেত্রেও চীন তাদের পছন্দের পঞ্চেন লামাকে নিয়োগ করে, যেখানে দলাই লামা কর্তৃক স্বীকৃত গেধুন চোয়েকী য়িমি-র কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
চীন এ কথাও স্পষ্ট করেছে যে তাদের নির্বাচিত ১৫তম দলাই লামাই “বৈধ” হিসেবে গণ্য হবেন, এবং এর জন্য তারা ধর্মীয় পুনর্জন্মের অনলাইন নজরদারিও শুরু করেছে। কিন্তু তিব্বতিরা এটিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে।
ভারত ও আমেরিকার ভূমিকা
ভারত ১৯৫৯ সাল থেকে তিব্বতি নির্বাসিত প্রশাসনকে আশ্রয় দিয়েছে এবং প্রায় ১ লক্ষ তিব্বতি শরণার্থী এখানে বসবাস করেন। ভারত চীনের অসন্তুষ্টির ভয়ে প্রায়শই প্রকাশ্যে নীরব থাকে, তবে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার স্তরে তিব্বতিদের সমর্থন করে এসেছে। অন্যদিকে, আমেরিকা ২০২০ সালে পাস হওয়া তিব্বতি নীতি ও সমর্থন আইনের মাধ্যমে পরিষ্কার করেছে যে পরবর্তী দলাই লামা তিব্বতি প্রথা অনুযায়ীই নির্বাচিত হবেন। এতে চীনের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের জন্য নিষেধাজ্ঞার বিধানও রয়েছে।
৬ই জুলাই, ২০২৫: ঐতিহাসিক তারিখ
এখন সবার চোখ ৬ই জুলাই, ২০২৫-এর দিকে, যখন ১৪তম দলাই লামার ৯০তম জন্মবার্ষিকী ধর্মশালায় উদযাপন করা হবে। সূত্রানুসারে, এই অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর উত্তরসূরি সম্পর্কে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করতে পারেন। এটি শুধু তিব্বতি সম্প্রদায়ের জন্য নয়, চীন এবং সারা বিশ্বের জন্যও একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হবে। যদি দলাই লামা তাঁর জীবদ্দশাতেই উত্তরসূরি ঘোষণা করেন, তবে এটি তিব্বতি পরিচয় ও ধর্মীয় প্রথা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি সাহসী পদক্ষেপ হবে।
তিব্বতিদের আশা ও উদ্বেগ
তিব্বতি শরণার্থী এবং সারা বিশ্বের তিব্বতি বৌদ্ধ অনুসারীদের মধ্যে দলাই লামার এই উদ্যোগ নিয়ে আশা ও উদ্বেগ দুটোই রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে তিব্বতি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবে, কিন্তু একই সাথে উদ্বেগও রয়েছে যে চীন এর বিরোধিতা করবে এবং তিব্বতের অভ্যন্তরে তাদের মনোনীত “দলাই লামা” চাপিয়ে দেবে। দলাই লামার এই সিদ্ধান্ত তাঁর জীবদ্দশাতেই উত্তরসূরি ঘোষণার সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করে। এটি কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা রক্ষা নয়, চীনের মতো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তিব্বতি আত্মপরিচয়ের একটি শান্তিপূর্ণ চ্যালেঞ্জও হবে।