আজকের দিনে, যেখানে সবাই একটি ভালো জীবনযাত্রার সন্ধান করছে, সেখানে কিছু রোগ আছে যা নীরবে শরীরের অভ্যন্তরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কিডনি, অর্থাৎ আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শরীরের টক্সিন বের করতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং জলের স্তরকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ডায়াবেটিস (বহুমেহ) এবং উচ্চ রক্তচাপ (উচ্চ রক্তচাপ) এমন দুটি সাধারণ রোগ যা ধীরে ধীরে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
কিডনি কীভাবে কাজ করে?
কিডনি শরীরের প্রাকৃতিক ফিল্টার মেশিন। এটি রক্তকে ফিল্টার করে বিষাক্ত পদার্থ এবং অতিরিক্ত তরলকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। এছাড়াও, এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে এবং লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়ক। যখন কিডনির ফিল্টারিং ইউনিট (গ্লোমেরুলাস)-এর ক্ষতি হয়, তখন এই কাজগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) শুরু হয়।
ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ কীভাবে কিডনির ক্ষতি করে?
১. ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসে শরীরের ব্লাড সুগার লেভেল ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত চিনি রক্তনালীগুলির ক্ষতি করে, বিশেষ করে কিডনিতে থাকা গ্লোমেরুলাসকে (ছোট ফিল্টার ইউনিট)। এর ফলে কিডনির ফিলট্রেশন ক্ষমতা কমে যায় এবং কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ে। এই পরিস্থিতিকে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি বলা হয়।
২. উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ কিডনির রক্তনালীগুলির উপর চাপ বাড়ায়, যার ফলে সেগুলি শক্ত এবং সংকীর্ণ হয়ে যায়। এর ফলে কিডনিতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের কার্যকারিতা দুর্বল হতে শুরু করে।
যখন এই দুটি অবস্থা একসাথে হয়, তখন কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, এর প্রভাব প্রাথমিক পর্যায়ে খুব বেশি অনুভূত হয় না এবং যখন এটি সনাক্ত করা যায়, তখন কিডনি ৬০-৭০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)-এর সাধারণ লক্ষণ
যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, তবে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
- মুখ, পা এবং গোড়ালিতে ফোলাভাব
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বিশেষ করে রাতে
- ফেনা যুক্ত বা দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব
- ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং ক্ষুধা হ্রাস
- লगातार উচ্চ রক্তচাপ যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
গুরুত্বপূর্ণ: কারো যদি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে কোনো লক্ষণ না থাকলেও বছরে অন্তত একবার কিডনির পরীক্ষা করানো উচিত।
কিডনিকে সুরক্ষিত রাখতে এই ব্যবস্থা নিন
১. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন
ডায়াবেটিস রোগীদের HbA1c লেভেল ৭%-এর নিচে রাখা উচিত। এটি কিডনির উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবকে এড়াতে পারে।
২. রক্তচাপের উপর নজর রাখুন
উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের ব্লাড প্রেসার ১৩০/৮০ mmHg-এর নিচে রাখা উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ নিয়মিত খান এবং নুনের পরিমাণ কমান।
৩. সময়মতো পরীক্ষা করান
বছরে একবার প্রস্রাবে প্রোটিনের পরীক্ষা এবং ক্রিয়েটিনিন লেভেল পরীক্ষা করানো উচিত। এটি কিডনির স্বাস্থ্যের সঠিক ধারণা দিতে পারে।
৪. স্বাস্থ্যকর খাবার খান
- কম নুন এবং কম চিনিযুক্ত খাবার খান
- প্রক্রিয়াজাত খাবার, লাল মাংস এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন
- ফল, সবুজ শাকসবজি, ডাল এবং গোটা শস্য খাদ্যতালিকায় যোগ করুন
- পর্যাপ্ত পরিমাণে জল (প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস) পান করুন
৫. নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ করুন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, যোগা বা হালকা ব্যায়াম করুন। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং রক্তচাপ ও ব্লাড সুগারকে স্থিতিশীল রাখবে।
৬. ওষুধ সাবধানে ব্যবহার করুন
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক বা অন্য কোনো ওষুধ সেবন করবেন না। এগুলো কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সাধারণ রোগ যখন কিডনির ক্ষতি করতে শুরু করে, তখন চিকিৎসার পথ দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল হয়ে যায়। তবে সঠিক সময়ে সতর্কতা, নিয়মিত পরীক্ষা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনে এই বিপদ থেকে বাঁচা যায়। মনে রাখবেন, কিডনির রোগ নীরবে আসে কিন্তু গভীর প্রভাব ফেলে। তাই আজই পরীক্ষা করান এবং আপনার কিডনিকে দীর্ঘ জীবন দিন।