ইতিহাসের পাতায় বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা উঠলে কিছু নাম অমর হয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মেরি ক্যুরি — এমন একজন বিজ্ঞানী যিনি শুধু তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity)-র মতো কঠিন বিষয় নিয়ে কাজ করেননি, বরং বিশ্বের প্রথম মহিলা হিসেবে দুটি ভিন্ন বিজ্ঞান বিভাগে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর জীবন সংগ্রাম, উৎসর্গ এবং বিজ্ঞানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শৈশব এবং প্রারম্ভিক জীবন
মেরি ক্যুরির জন্ম ৭ নভেম্বর, ১৮৬৭ সালে, পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে। তাঁর আসল নাম ছিল 'মারিয়া সালোমিয়া স্ক্লোডোভস্কা'। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। তাঁর বাবা-মা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন, কিন্তু পোল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাতীয় বিদ্রোহের কারণে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তবুও, মারিয়ার পড়াশোনা কোনোদিন বন্ধ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই তিনি গণিত ও পদার্থবিদ্যায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে বিজ্ঞান-উপকরণ ব্যবহার করতে শিখেছিলেন। যদিও মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল, তবুও তিনি 'ফ্লাইং ইউনিভার্সিটি' নামক একটি গোপন সংস্থায় পড়াশোনা করে বৈজ্ঞানিক যাত্রা শুরু করেন।
শিক্ষার জন্য প্যারিসের পথে
১৮৯১ সালে, যখন তাঁর বয়স ২৪ বছর, তিনি নিজের দেশ ছেড়ে ফ্রান্সের প্যারিসে পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় (সোরবন)-এ পড়াশোনা করা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। সেখানে তিনি আর্থিক অনটন, ক্ষুধা এবং একাকিত্বের শিকার হন, কিন্তু কোনোদিন হার মানেননি। শীতকালে তিনি প্রায়ই কোট ছাড়াই পড়াশোনা করতেন, এমনকি খাবারও ত্যাগ করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি তাঁর মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং খুব শীঘ্রই বিজ্ঞানী মহলে পরিচিতি লাভ করেন।
পিয়ের ক্যুরি: জীবনসঙ্গী এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগী
১৮৯৪ সালে তাঁর সাথে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের ক্যুরির সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের চিন্তা এবং বিজ্ঞানের প্রতি উৎসর্গীকৃত মনোভাব তাঁদের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং ১৮৯৫ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত ছিল না, বরং বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও ঐতিহাসিক ছিল। তাঁরা একসঙ্গে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং ১৮৯৮ সালে পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম নামক দুটি নতুন মৌল আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার বিজ্ঞান জগৎকে আলোড়িত করে তোলে। এই ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে তাঁরা পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান, যা তিনি পিয়ের এবং হেনরি বেকরেলের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তিনি প্রথম মহিলা যিনি নোবেল পুরস্কার পান।
স্বামীর মৃত্যু এবং দ্বিতীয় নোবেল
১৯০৬ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পিয়ের ক্যুরির মৃত্যু হয়। এই ঘটনা মেরির জন্য গভীর আঘাত ছিল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নেন এবং বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা আরও দৃঢ় করেন। তাঁকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়, যা সেই সময়ে কোনো মহিলার জন্য প্রথম ছিল। ১৯১১ সালে তিনি রসায়নশাস্ত্রে দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার পান — এই সম্মান তিনি রেডিয়াম এবং পোলোনিয়ামের আবিষ্কার ও তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার জন্য পান। দুটি ভিন্ন বিভাগে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনি আজও স্মরণীয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও মানবতার সেবা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, মেরি ক্যুরি মোবাইল এক্স-রে ইউনিট তৈরি করেন, যা "লিটল ক্যুরিজ" নামে পরিচিত ছিল। তিনি এই ইউনিটগুলো নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যান এবং হাজার হাজার আহত সৈনিকের পরীক্ষা ও চিকিৎসায় সহায়তা করেন। তিনি তাঁর মেয়ে আইরিনকেও এই কাজে যুক্ত করেন, যিনি পরে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হন এবং ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান। মেরি শুধু বিজ্ঞানচর্চায় নয়, মানবসেবার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
সংস্থা গঠন এবং ভবিষ্যতের ভিত্তি
মেরি ক্যুরি ১৯২০ সালে প্যারিসে এবং ১৯৩২ সালে তাঁর জন্মস্থান ওয়ারশ-তে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য ছিল তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করা এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার করা। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে চিকিৎসা ও বিজ্ঞান উভয় দিকেই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। আজও এই প্রতিষ্ঠানগুলি চিকিৎসা গবেষণার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
পোলিশ আত্মা ও সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ
মেরি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও, তিনি কখনও তাঁর পোলিশ পরিচয় ত্যাগ করেননি। তিনি তাঁর মেয়েদের পোলিশ ভাষা শিখিয়েছেন এবং বারবার পোল্যান্ডে গিয়েছেন। তিনি তাঁর প্রথম আবিষ্কৃত মৌলের নাম পোলোনিয়াম রাখেন, যা তাঁর দেশ পোল্যান্ডকে সম্মান জানানোর প্রতীক ছিল।
মৃত্যু ও অমরত্ব
মেরি ক্যুরির জীবন সাহস, উৎসর্গ এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার প্রতীক। তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও হার মানেননি এবং বিজ্ঞানের জগতে এক অমোঘ ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর আবিষ্কারগুলি শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন পথ দেখায়নি, নারীদেরও বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করেছে। তিনি আজও জ্ঞান, সেবা এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির দৃষ্টান্ত। মেরি ক্যুরি সত্যিই একজন মহান এবং অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি ছিলেন।