টোকিও সফরে বিরল উপহার
জাপান সফরে গিয়ে এক অনন্য সাংস্কৃতিক উপহার পেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারত-জাপান শীর্ষ সম্মেলনের ব্যস্ততার মধ্যেই টোকিয়োর দারুমা-জি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড সেইশি হিরোসে তাঁর হাতে তুলে দেন এক দারুমা পুতুল। জাপানি সংস্কৃতির অমূল্য এই প্রতীক হঠাৎ উপহার নয়, বরং এক গভীর বার্তার প্রতীক, যা কূটনৈতিক সৌহার্দ্যকেও নতুন মাত্রা দিল।
দারুমা পুতুল: জাপানি সংস্কৃতির প্রতীক
লাল রঙে মোড়া, গোলাকৃতি এই দারুমা পুতুল জাপানি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক। একে সৌভাগ্য, আত্মবিশ্বাস ও অধ্যবসায়ের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। পুতুলটি উল্টে গেলেও আবার দাঁড়িয়ে যায়—যা মানুষের অদম্য চেষ্টার প্রতীক। উপহার হিসেবে মোদীর হাতে এটি তুলে দিয়ে জাপান যেন প্রতীকীভাবে বার্তা দিল, যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাতেও ভারত-জাপান সম্পর্ক দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ভারতের সঙ্গে অটুট যোগসূত্র
এই দারুমা পুতুলের শেকড়ও কিন্তু ভারতের মাটিতেই গাঁথা। ইতিহাস বলছে, জাপানে জেন বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বোধিধর্ম ছিলেন ভারতের তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিনি প্রথমে চিনে এবং পরে জাপানে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেন। সেখানেই পরিচিত হন ‘দারুমা দাইশি’ নামে। অর্থাৎ, যে প্রতীক আজ জাপানের সংস্কৃতিকে বহন করছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল ভারতেই। ফলে এই উপহার যেন দুই দেশের ঐতিহাসিক সেতুবন্ধনকে আরও মজবুত করল।
নয় বছরের ধ্যান থেকে জন্ম কিংবদন্তির
বোধিধর্মের কাহিনি ঘিরেই দারুমা পুতুলের জন্ম। বলা হয়, তিনি টানা নয় বছর ধরে একটানা ধ্যান করেছিলেন। সেই সময় দীর্ঘ ধ্যানের কারণে তাঁর হাত-পা প্রায় অসাড় হয়ে যায়। সেই অবস্থার প্রতীক হিসেবেই জন্ম নেয় গোলাকার দারুমা পুতুল। আজকের দিনে এই পুতুল যেন মানুষের দৃঢ় মানসিকতা ও অধ্যবসায়ের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে।
জাপানি বিশ্বাস ও রীতিনীতি
জাপানে প্রচলিত একটি বিশেষ রীতি এই পুতুলকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। কেউ যদি কোনও লক্ষ্য স্থির করেন, তবে প্রথমে দারুমা পুতুলের একটি চোখ রঙ করা হয়। লক্ষ্য পূর্ণ হলে রঙ করা হয় অন্য চোখটিও। এই প্রক্রিয়া শুধু বিশ্বাস নয়, বরং মানুষের মনকে দৃঢ় সংকল্পে বেঁধে রাখার এক প্রতীকী রীতি। তাই জাপানি প্রবাদে বলা হয়—“সাত বার পড়ে যাও, আট বার উঠে দাঁড়াও।”
সাংস্কৃতিক উপহার নাকি রাজনৈতিক ইঙ্গিত?
এই উপহারকে কেবল সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখা ভুল হবে। জাপান এমন এক প্রতীক তুলে দিল, যা ভারতকেও তাদের সংস্কৃতির অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মোদীর হাতে এই পুতুল তুলে দিয়ে টোকিও যেন বার্তা দিল—ভারত ও জাপান শুধু অর্থনীতি বা প্রতিরক্ষায় নয়, সংস্কৃতিতেও একে অপরের সঙ্গে অটুটভাবে জড়িত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি এক ধরণের সাংস্কৃতিক কূটনীতি, যা ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উঁচুতে নিয়ে যাবে।
ভারতের জনমনে প্রতিক্রিয়া
ভারতীয় মহলে এই উপহারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে উচ্ছ্বাস। অনেকেই মনে করছেন, জাপান আসলে ভারতের ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মোদীর ব্যক্তিগত কূটনৈতিক সাফল্যও বটে, কারণ এর মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন।
ভারত-জাপান সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
অতীতে নরেন্দ্র মোদী ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বহুবার একে অপরের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে। দারুমা পুতুল সেই সম্পর্কের সাংস্কৃতিক ছোঁয়া। ফলে এই উপহার নিছক প্রতীক নয়, বরং ভারত-জাপান বন্ধুত্বের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করল।