মহররম: কারবালার শোক ও শাহাদাতের স্মৃতি

মহররম: কারবালার শোক ও শাহাদাতের স্মৃতি

ইসলামিক ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হল মহররম, যা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত মাস হিসেবে বিবেচিত হয়। মহররম মাসকে আল্লাহ্‌র চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে গণনা করা হয়। এই মাসের ১০ তারিখে ‘ইয়াওম-এ-আশুরা’ পালন করা হয়, যা মুসলমানদের জন্য গভীর শোক ও শাহাদাতের স্মৃতি নিয়ে আসে।

হযরত হোসেন কে ছিলেন

হযরত হোসেন ইবনে আলী, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ছিলেন। তাঁর জন্ম হয় ৬২০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ইসলামী ইতিহাসে সততা, ন্যায়বিচার ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে গণ্য হন। তিনি তাঁর দাদা হযরত মোহাম্মদের (সা.) দেখানো পথে জীবন যাপন করেন। সমাজে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল একজন খাঁটি ও ধর্মনিষ্ঠ মানুষের।

কীভাবে শুরু হয়েছিল কারবালার সংগ্রাম

নবী করিম (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার সূচনা হয়। কিছুকাল সঠিক পথে চলার পর যখন ইয়াজিদ নামক এক শাসক ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেন। ইয়াজিদ চেয়েছিলেন সকল ইসলামী নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করুক।

হোসেন (রা.) এর বিরোধিতা করেন এবং ইয়াজিদের কথা মানতে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, ইয়াজিদের শাসন ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী ছিল।

হোসেনের (রা.) অস্বীকৃতির পর কী ঘটেছিল

যখন হোসেন (রা.) ইয়াজিদের আদেশ মানতে রাজি হননি, তখন ইয়াজিদ তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। জানা যায়, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ছিল, যেখানে হোসেনের (রা.) সঙ্গে ছিলেন মাত্র ৭২ জন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কারবালার ময়দান শাহাদাতের সাক্ষী হলো

হোসেন (রা.) তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে মক্কা থেকে কুফার দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁদের বাধা দেয়। সেখানে শুধু তাঁদের ঘেরাও করা হয়নি, বরং পানি সহ মৌলিক চাহিদাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

১০ই মহররম কারবালার যুদ্ধ শুরু হয়। একদিকে ছিল ইয়াজিদের বিশাল সেনাবাহিনী, অন্যদিকে ছিলেন হোসেন (রা.) ও তাঁর কয়েকজন অনুগত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই সংগ্রামে একে একে হোসেনের (রা.) সকল সঙ্গী শাহাদাত বরণ করেন। পরিশেষে, হোসেন (রা.)ও আহত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন।

এই দিনের স্মরণে কেন শোক পালন করা হয়

১০ই মহররম হোসেনের (রা.) শাহাদাতের স্মরণে সারা বিশ্বের মুসলমানরা শোক পালন করেন। বিশেষ করে শিয়া মুসলিমরা এই দিনে শোক মিছিল বের করেন, তাজিয়া রাখেন এবং বুক চাপড়ান। এটি এমন একটি দিন যখন মানবতা, ন্যায়বিচার ও ধর্মের জন্য উৎসর্গীকৃত আত্মত্যাগকে স্মরণ করা হয়।

এই দিনের অন্যান্য ঐতিহাসিক দিক

ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যেমন, মনে করা হয়, এই দিনে হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিছু ধারণায় আরও বলা হয় যে, এই দিনে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে তীরে ভিড়েছিল।

সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্য পালন করা হয়

ভারত, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, লেবানন ও বাহরাইনের মতো দেশগুলোতে আশুরার দিনে ব্যাপক ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও রক্ত মাখানো, তাজিয়া বিসর্জন এবং লঙ্গরখানার আয়োজন করা হয়।

হোসেনের (রা.) স্মরণে পালিত এই দিনটি প্রতি বছর হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগগুলোর একটির সাক্ষ্য বহন করে। 

Leave a comment