হিন্দু ধর্মে মোট ষোলটি সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হল মুণ্ডন। এটিকে 'চৌল কর্ম'ও বলা হয়। এটি শিশুর জীবনের প্রথম বড় শুদ্ধিকরণ সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়। যখন শিশু প্রথমবার মাথার চুল কাটে, তখন এটি কেবল একটি সাধারণ ক্রিয়া নয়, আধ্যাত্মিক, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হিসাবে গণ্য করা হয়।
প্রথমবার চুল কাটার সঠিক সময়
প্রথা অনুসারে, মুণ্ডন শিশুর প্রথম বছরের শেষে, অথবা তৃতীয়, পঞ্চম বা সপ্তম বছরে করানো হয়। কিছু পরিবারে মেয়েদের মুণ্ডন দ্বিতীয় বা চতুর্থ বছরেও হয়ে থাকে। এর পেছনে ধারণা হল, চুল কাটলে শিশুর পুরনো কর্ম এবং নেতিবাচক প্রভাব দূর করা যায় এবং তার জীবনে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়।
ডাক্তাররা কী বলেন
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, নবজাতকের মাথার খুলির হাড় ধীরে ধীরে জোড়া লাগে। এই হাড়গুলি সম্পূর্ণভাবে দেড় বছর বয়স পর্যন্ত মজবুত হয়। এমন পরিস্থিতিতে, মুণ্ডন করানোর সময় খেয়াল রাখতে হয় যে শিশুর মাথা সম্পূর্ণভাবে মজবুত হয়েছে কিনা।
কখন শুভ মুহূর্ত তৈরি হয়
মুণ্ডন সংস্কারের জন্য তিথি, দিন, নক্ষত্র, লগ্ন এবং গ্রহের অবস্থান দেখা হয়। এই মুহূর্ত জন্মছকের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়, যাতে শিশু সর্বাধিক সুবিধা পেতে পারে।
কোন কোন তিথি শুভ বলে মনে করা হয়
দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, পঞ্চমী, সপ্তমী, দশমী, একাদশী এবং ত্রয়োদশী তিথি মুণ্ডনের জন্য শুভ বলে মনে করা হয়। এই তিথিগুলোকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচক শক্তির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হয়।
সপ্তাহের কোন দিনগুলি ভালো
সোমবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার মুণ্ডন করা শুভ বলে মনে করা হয়। যদিও শুক্রবার মেয়েদের মুণ্ডন করা নিষেধ। শনিবার, রবিবার এবং মঙ্গলবার এই সংস্কার এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
শুভ নক্ষত্র কোনটি
জ্যোতিষশাস্ত্রে কিছু নক্ষত্রকে বিশেষভাবে মুণ্ডনের জন্য শুভ বলা হয়েছে। যেমন অশ্বিনী, মৃগশিরা, পুনর্বসু, হস্ত, পুষ্যা, चित्रा, স্বাতী, জ্যেষ্ঠা, শ্রবণ, ধনিষ্ঠা এবং শতভিষা। এই নক্ষত্রগুলিতে করা সংস্কার ভবিষ্যতে শুভ ফল দেয় বলে মনে করা হয়।
রাশি এবং লগ্নের অনুসারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
সূর্য যখন মেষ, বৃষ, মিথুন, মকর এবং কুম্ভ রাশিতে থাকে, সেই সময়ে মুণ্ডন সংস্কার করা শুভ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম এবং দ্বাদশ লগ্নে এই কর্ম করলে উপকার পাওয়া যায়।
কখন মুণ্ডন করা উচিত নয়
এমন কিছু সময় আছে যখন মুণ্ডন সংস্কার নিষিদ্ধ। যেমন:
- চাতুর্মাস-এর সময়, যখন ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকেন, সেই সময়ে কোনও প্রকার মাঙ্গলিক কাজ করা হয় না।
- অধিক মাস বা মলমাসেও এই সংস্কার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
- জ্যৈষ্ঠ মাসে জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুণ্ডন করাও নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়।
- মা গর্ভবতী হলে, বিশেষ করে যদি তিনি ৫ মাস বা তার বেশি গর্ভবতী হন, তাহলে বড় ছেলের মুণ্ডন সংস্কার করা হয় না।
- জন্ম নক্ষত্র এবং জন্ম রাশিতে, বা যখন চন্দ্র চতুর্থ, অষ্টম, দ্বাদশ এবং শত্রু স্থানে থাকে, তখন মুণ্ডন নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কেন মুণ্ডন জরুরি
জ্যোতিষশাস্ত্রে মুণ্ডনকে কেবল একটি প্রথা হিসেবে নয়, বরং গ্রহের প্রভাবকে संतुलित করার একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়। এই সংস্কার শিশুর জন্মছকে বিদ্যমান গ্রহের স্থিতিকে संतुलित করতে সহায়ক। বিশেষ করে শিশুর মাথায় জন্মের সময় যে চুল থাকে, তা পূর্বজন্মের কর্মের সঙ্গে জড়িত। মনে করা হয়, এই চুলের সঙ্গে পূর্বজীবনের কিছু ঋণ বা নেতিবাচক প্রভাবও অবশিষ্ট থাকে।
মুণ্ডন করে এগুলি দূর করা হয়, যাতে শিশু নতুন জীবনে সম্পূর্ণরূপে शुद्ध মন ও আত্মার সাথে এগিয়ে যেতে পারে।
শুদ্ধতা, শক্তি এবং বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত এই কর্ম
বলা হয়, যখন মাথা মুণ্ডন করা হয়, তখন মানসিক স্বচ্ছতা এবং একাগ্রতা বাড়ে। এর ফলে শিশুর মস্তিষ্কও ভালোভাবে বিকাশ লাভ করে। প্রাচীনকালে এমনও ধারণা ছিল যে চুল কাটলে চুলের গোড়া মজবুত হয়, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যকর চুল গজাতে সাহায্য করে।
নकारात्मक শক্তি থেকে সুরক্ষা
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুণ্ডন শিশুকে কুদৃষ্টি, নেতিবাচক শক্তি এবং অজানা বিপদ থেকে রক্ষা করে। এই সংস্কার এক প্রকার তার শক্তিকে নতুন দিকে পরিচালিত করে এবং আত্মিক স্তরে শুদ্ধ করার কাজ করে।
পারিবারিক প্রথাতেও বিশেষ গুরুত্ব
ভারতের বিভিন্ন অংশে মুণ্ডনের আলাদা আলাদা প্রথা রয়েছে। কোথাও এটি কোনো কাছের তীর্থস্থানে গিয়ে করা হয়, আবার কোথাও গ্রাম বা বাড়ির উঠোনে এই সংস্কার সম্পন্ন হয়। কোথাও কুলদেবতা বা কুলদেবীর মন্দিরে মুণ্ডন করানো জরুরি বলে মনে করা হয়।
এই সংস্কার একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে করা হয়, যেখানে হোম, পূজা এবং আশীর্বাদের আয়োজন করা হয়। পরিবারের সকল সদস্য এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন।