দৃষ্টিহীন হয়েও রবীন্দ্র জৈন ভক্তি সঙ্গীতকে নতুন পরিচয় দিয়েছিলেন, ‘রামায়ণ’-এর অমর ভজনগুলি তাঁর কণ্ঠস্বরে প্রতিটি ঘরে অনুরণিত হত, সুরের উত্তরাধিকার আজও অম্লান।
রবীন্দ্র জৈন: বলিউড জগতে যখন সুরের কথা আসে, তখন সেইসব কিংবদন্তি শিল্পীদের কথা অবশ্যই উল্লেখ করা হয়, যাঁদের সঙ্গীত শুধু সিনেমাকেই নয়, হৃদয়কেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। তেমনই এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবীন্দ্র জৈন, যাঁর চোখে আলো না থাকলেও, তাঁর সুরে এক আলোকোজ্জ্বল জগৎ বাস করত।
রবীন্দ্র জৈন কেবল একজন সঙ্গীত পরিচালক বা গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভক্তি ও অনুভূতির এক সেতুবন্ধন, যিনি কোটি কোটি ভারতীয়র মনে আধ্যাত্মিকতা ও শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিলেন। বিশেষ করে, রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ'-এর মাধ্যমে তাঁর গাওয়া ভজনগুলি এমন জাদু তৈরি করেছিল যে আজও ভারতের প্রতিটি ঘরে বাজে – 'শ্রীরামচরিতমানস শুনি লিজিয়ে' থেকে শুরু করে 'ভজ মন রামচরণ সুখদায়ী' পর্যন্ত।
জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন, কিন্তু আত্মা থেকে সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত
২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে উত্তর প্রদেশের আলীগড় জেলার কাসগঞ্জ শহরে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্র জৈন ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতকে তাঁর আশ্রয় বানিয়েছিলেন। জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও, তিনি হার মানেননি এবং সুরের মাধ্যমেই জগৎ দেখা শুরু করেন। তাঁর বাবা-মা যখন সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখলেন, তখন তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য কোনো ত্রুটি রাখেননি।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীরে প্রবেশ করতে করতে রবীন্দ্র জৈন ধীরে ধীরে ভজন, চলচ্চিত্রের গান এবং লোকসংগীতের এক अद्भुत সংমিশ্রণ তৈরি করেন।
বলিউডে সুরের আগমন: ‘সওদাগর’ দিয়ে যাত্রা শুরু
১৯৭৩ সালে ‘সওদাগর’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি বলিউডে প্রবেশ করেন এবং প্রথম ছবিতেই এমন সঙ্গীত রচনা করেন যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর পরে 'চোর मचाয়ে शोर', 'গীত গাটা চল', 'শতরঞ্জ কে মোহরে'-এর মতো ছবিতে তিনি একের পর এক হিট গান উপহার দেন।
কিন্তু ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চিতচোর’ তাঁকে আসল পরিচিতি এনে দেয়। এই ছবির গান ‘গোরি তেরা গাঁও বড়া প্যারা’ যেন হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতের এক অমর গানে পরিণত হয়েছিল। এই গানের সারল্য ও মাধুর্য রবীন্দ্র জৈনের আত্মার গভীরতা থেকে এসেছিল।
১২৩টির বেশি ছবিতে সঙ্গীত, প্রতিটি গানই অনুভূতির দৃষ্টান্ত
রবীন্দ্র জৈন শুধু গানই করেননি, তিনি বহু চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীতও তৈরি করেছেন। তিনি ১২৩টির বেশি ছবিতে কাজ করেছেন এবং তাঁর তৈরি করা অনেক গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
সেটা ‘ফকিরা চল চালাচল’ হোক, ‘যানেওয়ালে ও যানেওয়ালে’ হোক বা ‘দিল মে তুঝে বৈঠা কর’ – প্রতিটি গানেই রবীন্দ্র জৈনের আত্মা কথা বলত। তাঁর সঙ্গীত রচনা সবসময় সুর, সরলতা এবং খাঁটি অনুভূতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হত – যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করত।
রামায়ণে ভক্তির সুর: ভজন যাঁর অভাবে শ্রদ্ধা অসম্পূর্ণ
১৯৮৭ সালে যখন দূরদর্শনে রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ' সম্প্রচার শুরু হয়, তার সঙ্গে সঙ্গেই একটি কণ্ঠস্বর প্রতিটি ঘরে অনুরণিত হতে শুরু করে – সেটি ছিল রবীন্দ্র জৈনের কণ্ঠস্বর।
তিনি কেবল রামায়ণের ভজনগুলিকে সুর দেননি, বরং সেটিকে একটি আধ্যাত্মিক সঙ্গীত যাত্রায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
তাঁর গাওয়া ভজন যেমন:
- 'ভজ মন রামচরণ সুখদায়ী',
- 'শ্রীরামচরিতমানস শুনি লিজিয়ে',
- 'পায়েল বাজে হনুমান কি'
আজও ভক্তি সঙ্গীতের পরিচয় বহন করে।
রবীন্দ্র জৈন সেই সময়ে, যখন ভক্তি সঙ্গীত কেবল মন্দিরগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল, তখন সেটিকে টিভি এবং রেডিওর মাধ্যমে প্রতিটি ঘরের সকাল এবং সন্ধ্যার অংশে পরিণত করেছিলেন।
রবীন্দ্র জৈন: এক যুগের সমাপ্তি, কিন্তু সুরের উত্তরাধিকার অমর
৯ অক্টোবর ২০১৫ সালে যখন রবীন্দ্র জৈন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন সঙ্গীত প্রেমীদের হৃদয়ে শোকের ঢেউ লাগে। কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ার পরেও তাঁর সুর অমর হয়ে আছে।
তাঁর জীবন এই কথার উদাহরণ যে শরীরের সীমাবদ্ধতা প্রতিভার উড়ানকে রুখতে পারে না। তিনি প্রমাণ করেছেন যে সঙ্গীত চোখ দিয়ে নয়, আত্মা থেকে জন্ম নেয়।