বছর ঘুরেও ক্ষত শুকোয়নি

বছর ঘুরেও ক্ষত শুকোয়নি

এক বছর আগে ১৪ আগস্ট রাতেই শুরু হয়েছিল ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব অধ্যায়—‘রাত দখল’। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে মহিলারা, পুরুষেরা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সবাই এক কণ্ঠে পথে নেমেছিলেন। ফুলকির মতো শুরু হওয়া সেই আন্দোলন মুহূর্তে দাবানলে পরিণত হয়েছিল। আজ, ১৪ আগস্ট ২০২5—আবারও সেই রাতের ডাক। কিন্তু প্রশ্ন, আবেগ কি এখনও ততটাই উজ্জ্বল?

প্রথম রাতের আগুন

গত বছরের রাত দখল ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার ঝড়ে ভাসা। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী রিমঝিম সিনহার একটি পোস্ট সারা বাংলায় রক্ত গরম করে দিয়েছিল। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট—লক্ষাধিক মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গিয়েছিল বার্তা। কলকাতা থেকে দিল্লি, লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক—বাংলার প্রতিবাদের সুর ছড়িয়েছিল সীমানার বাইরে।

এবারের ম্লান সাড়া

এই বছর, সেই ঝড়ের ছোঁয়া যেন নেই। ৬ আগস্ট রিমঝিমের নতুন ডাক শেয়ার হয়েছে মাত্র ১০ বার, লাইক ১০৭। গতবারের তুলনায় যেন শ্বাসরুদ্ধ। প্রথম সারির তারকাদের পেজও নীরব—প্রতিবাদের ছবির বদলে সেখানে সিনেমার টিজার, ব্যক্তিগত পোস্ট বা অন্য খবরের আভাস।

নীরব তারকাদের আঙুল তুলে প্রশ্ন

স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের প্রোফাইলে পথকুকুর ইস্যুতে সরব পোস্ট আছে, কিন্তু ‘রাত দখল’-এর একটিও লাইন নেই। অভিনেত্রী সোহিনী সরকার যদিও "রঘু ডাকাত" সিনেমার প্রোমোশনে প্রতিবাদী ভাষা ব্যবহার করেছেন, তবুও আন্দোলনের ডাক নেই। সুদীপ্তা চক্রবর্তীর পেজও খালি। তাহলে কি এ বারও তারা পথে নামবেন, নাকি থাকবেন চুপচাপ?

প্রান্তের সরে আসা মুখ

গায়িকা লগ্নজিতা চক্রবর্তী এখন বেঙ্গালুরুতে। তাঁর সোজা কথা—“আমাকে চুপ থাকতে হবে।” নাট্যব্যক্তিত্ব সোহিনী সেনগুপ্ত জানালেন, তিনি অনেক দিন আগে থেকেই দূরত্ব তৈরি করেছেন। কারণ তাঁর মতে, আন্দোলনের শুদ্ধ আগুনে রাজনীতির ছায়া পড়েছে।

সংগঠকদের দৃঢ় অবস্থান

তবুও রিমঝিমের বিশ্বাস, ‘রাত দখল’ আন্দোলন নারীদের জোটবদ্ধ হতে শিখিয়েছে। তাঁর ডাক এবার যাদবপুরে। অন্যদিকে শতাব্দি দাশ অ্যাকাডেমি চত্বরে একই স্লোগান তুলেছেন—সরকারের কাছে এক বছরের পুরনো দাবিগুলো এখনও অগ্রাহ্য, তিলোত্তমার বিচার মেলেনি।

গত বারের ঢেউয়ের তুলনা

২০২৪-এর রাতে রাজপথে নেমেছিল হাজার হাজার মানুষ। মোমবাতি, পোস্টার, ঢাক-ঢোল, স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল শহর। এ বার কি সেই স্রোত বইবে? সংগঠকরা জানেন, আগুনের তাপ ধরে রাখা কঠিন। এক বছরের হতাশা ও ক্ষোভ হয়তো প্রতিবাদের রূপ বদলে দিতে পারে।

রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের অভিযোগ

কিছু মানুষের মতে, আন্দোলন শুরু হয়েছিল নিরপেক্ষ প্রতিবাদ হিসেবে, কিন্তু পরে রাজনৈতিক স্বার্থ এতে ঢুকে পড়েছে। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দ্বিধা ও হতাশা এসেছে। প্রশ্ন উঠছে—যদি রাজনীতি ঢুকে যায়, আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কি হারিয়ে যায়?

সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবের হ্রাস

সোশ্যাল মিডিয়ার জোয়ার ছাড়া ‘রাত দখল’ হয়তো এতদূর আসত না। কিন্তু এ বার অ্যালগরিদম, মানুষের আগ্রহ ও তারকাদের অনাগ্রহ মিলে সেই গতি কমিয়ে দিয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে প্রচারের আলো ম্লান।

মূল প্রাপ্তি ও বার্তা

তবুও সংগঠকদের মতে, সবচেয়ে বড় সাফল্য—মেয়েরা ভয় কাটিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। গৃহে, রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে—অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তুলতে শিখেছেন। আন্দোলনের এই মানসিক পরিবর্তনই দীর্ঘমেয়াদি লাভ।

পথচলার নতুন ধাপ

আজ রাতেই দেখা যাবে, পথ দখলের ডাক কতটা সাড়া ফেলে। গতবারের মতো জনসমুদ্র কি নেমে আসবে, নাকি ছোট ছোট গোষ্ঠীর প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকবে? বছরের পর বছর ধরে বিচারহীনতার ক্ষোভ কি আবারও রাজপথে আগুন ধরাবে?

Leave a comment