সত্যজিৎ রায়: জীবন, সিনেমা ও স্বাস্থ্য - এক চলচ্চিত্রকারের অজানা গল্প

সত্যজিৎ রায়: জীবন, সিনেমা ও স্বাস্থ্য - এক চলচ্চিত্রকারের অজানা গল্প

সত্যজিৎ রায় কেবল একটি নাম নয়, বরং ভারতীয় এবং বিশ্ব সিনেমার আত্মা। তাঁকে দেখলে মনে হয় যেন শিল্প, সংবেদনশীলতা এবং প্রযুক্তি একই শরীরে মিশে থাকতে পারে। কিন্তু আপনারা কি জানেন, এই চলচ্চিত্র জাদুকরের স্বাস্থ্য, তাঁর জীবনযাত্রা এবং মানসিক অবস্থা তাঁর সৃজনশীল জীবন থেকে কতটা গভীরভাবে জড়িত ছিল? আসুন, এই প্রবন্ধে আমরা সত্যজিৎ রায়ের জীবন, সিনেমা এবং তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করি, যে দিকটিকে প্রায়শই এড়িয়ে যাওয়া হয়।

শুরুর জীবন: উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সংবেদনশীলতা

২রা মে ১৯২১ সালে কলকাতার এক সুপরিচিত সাহিত্যিক এবং শিল্প-অনুরাগী পরিবারে সত্যজিৎ রায়ের জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি সৃজনশীলতার পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায় দুজনেই ছিলেন লেখক, চিত্রকর ও চিন্তাবিদ। কিন্তু তিন বছর বয়সে বাবার মৃত্যু সত্যজিতের জীবনে এক গভীর শূন্যতা ও কষ্টের জন্ম দেয়। এই মানসিক আঘাত ও আর্থিক অভাব সত্ত্বেও তাঁর সৃজনশীলতা কখনও থেমে থাকেনি। এমনও মনে করা হয় যে, শৈশবের একাকিত্ব ও মানসিক আঘাত সত্যজিতের মধ্যে গভীর সংবেদনশীলতার জন্ম দেয়— যা পরবর্তীকালে তাঁর চলচ্চিত্রের আত্মায় পরিণত হয়।

শিক্ষা ও চিত্রাঙ্কন: যেখান থেকে 'দৃষ্টি'-র বিকাশ শুরু

প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং তারপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতনে তিনি পড়াশোনা করেন। এখানে নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের কাছ থেকে তিনি 'দেখতে' শেখেন। এটি কেবল বাইরের দৃশ্য নয়, বরং মানুষের ভেতরের জগৎকে দেখার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, যা রায় তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। স্বাস্থ্য বিষয়ক দিক: শান্তিনিকেতনে পাওয়া এই সামগ্রিক শিক্ষা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এটি তাঁকে শহরের কোলাহল ও মানসিক চাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, যার ফলে তিনি মানসিকভাবে স্থিতিশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত থাকতে পেরেছিলেন।

স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা: শিল্পের প্রতি উৎসর্গ

সত্যজিৎ রায়ের জীবন প্রমাণ করে যে, যখন একজন ব্যক্তি তাঁর স্বপ্নের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হন, তখন তিনি শরীরের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করেন। তাঁর খাদ্যাভ্যাস অনিয়মিত ছিল, ব্যায়ামের কোনো নির্দিষ্ট রুটিন ছিল না, এবং তিনি দীর্ঘ শুটিং ও সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে, কিন্তু তিনি অবিরাম কাজ করে গেছেন।

সিনেমা যাত্রা: এক সাধনার শুরু

সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) যেন ভারতীয় সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই এবং অল্প বাজেটে তৈরি এই ছবি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। এর পরে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’-এর মাধ্যমে ‘অপু ট্রিলজি’ নির্মিত হয় — যা ভারতীয় সিনেমার অমূল্য সম্পদ। তাঁর প্রতিটি ছবি, তা ‘চারুলতা’ হোক বা ‘জলসাঘর’, জীবনের বাস্তবতা অত্যন্ত সরলভাবে তুলে ধরেছিল। তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষের গল্প বলেছেন — শিশু, নারী, গ্রামবাসী এবং শহরের মানুষ সকলের কথা।

মানসিক চাপ ও হৃদরোগ: পরিচালকের নীরব সংগ্রাম

১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’-র শুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায়ের গুরুতর হৃদরোগ হয়। এই স্বাস্থ্য সংকট এতটাই গভীর ছিল যে, এর পর থেকে তিনি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ডাক্তাররা তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিলেও, তিনি তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ করেননি। হৃদরোগের প্রধান কারণ ছিল—দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, অনিয়মিত জীবনযাত্রা এবং মানসিক ক্লান্তি। তাঁর দৈনন্দিন জীবনে ব্যায়াম বা স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো স্থান ছিল না। সিনেমা তাঁর কাছে নিছক পেশা ছিল না, বরং একটি সাধনা ছিল — আর এই সাধনায় তিনি তাঁর স্বাস্থ্যের বলিদান দিয়েছিলেন।

শেষ জীবন: সম্মান ও সংগ্রামের মিলন

১৯৯২ সালে যখন সত্যজিৎ রায় হাসপাতালে জীবনের শেষ দিনগুলো গুনছিলেন, সেই সময় তাঁকে হলিউডের সবচেয়ে সম্মানজনক ‘অস্কার’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি একটি ভিডিও বার্তা পাঠান, যেখানে তাঁর মুখ ক্লান্ত ছিল, কিন্তু চোখে সেই একই তেজ ছিল। ২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২ সালে তাঁর প্রয়াণের পর কলকাতা শহর যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর বাড়িতে ভিড় করেন। ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে সম্মানিত করে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা: শিল্পের সঙ্গে শরীরের যত্নও জরুরি

সত্যজিৎ রায়ের জীবন এক অনুপ্রেরণা, কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি সতর্কবার্তা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, একাগ্রতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করা যায়, কিন্তু শরীরের প্রতি যত্ন না নিলে এই মহত্ত্ব ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। আজকের তরুণ প্রজন্ম, যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ, লেখালেখি বা সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের রায় থেকে এই শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখাটাও শিল্পের প্রতি মনোযোগের মতোই জরুরি। যোগা, ধ্যান, সুষম আহার এবং নিয়মিত বিশ্রাম—এগুলি যে কোনো শিল্পীর জন্য শক্তির উৎস হতে পারে। সত্যজিৎ রায় তাঁর কঠোর পরিশ্রমে আমাদের অমর সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন, কিন্তু হয়তো তিনি যদি স্বাস্থ্যের প্রতি একটু বেশি সচেতন থাকতেন, তবে আরও অনেক বছর ধরে আমাদের পথ দেখাতে পারতেন।

সত্যজিৎ রায়ের জীবন একটি প্রদীপের মতো ছিল, যা নিজে জ্বলে অন্যদের পথ আলোকিত করেছে। তাঁর সিনেমা ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্ব দরবারে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। তাঁর গল্পগুলো আজও আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে, তাঁর জীবন আমাদের এই শিক্ষাও দেয় যে, কেবল সৃষ্টি দিয়ে নয়, সংযম ও ভারসাম্য দিয়েও জীবনকে মহৎ করা যেতে পারে।

Leave a comment