সে ছিল এক হিমেল সকাল, যখন শহরের কোলাহল তখনও শুরু হয়নি। কলেজের প্রথম দিন ছিল আর সব নতুন মুখ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যেই ছিল দুজন – আরভ আর সিয়া। দুজনের স্বভাব ছিল আলাদা – আরভ শান্ত, কম কথা বলা এবং বইয়ে ডুবে থাকা ছেলে, যেখানে সিয়া প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আর মন খুলে কথা বলা মেয়ে। ক্লাসের প্রথম দিনেই দুজনের চোখাচোখি হল, হালকা হাসি বিনিময় হল আর তারপর দুজনেই নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। কেউই জানত না যে এই প্রথম দেখার মুহূর্ত তাদের জীবন বদলে দেবে।
বন্ধুত্বের শুরু
কলেজের দিনগুলিতে গ্রুপ প্রজেক্ট আর অ্যাসাইনমেন্টগুলো দুজনকে একে অপরের কাছে নিয়ে এল। সিয়া, যে সবসময় সবার সাথে কথা বলত, ধীরে ধীরে আরভের সাথেও মিশে যেতে লাগল। আরভের সিয়ার বেপরোয়া স্বভাব ভালো লাগতে শুরু করল, আর সিয়া আরভের শান্ত স্বভাবের গভীরে ডুব দিতে লাগল। কমন লাইব্রেরি টাইম, ক্যান্টিনে চায়ের কাপ আর ক্যাম্পাসের গাছের নীচে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প – সবকিছু যেন সিনেমার মতো লাগতে লাগল। দুজনে বুঝতেই পারল না কখন বন্ধুত্ব, প্রয়োজনে পরিণত হল।
অব্যক্ত অনুভূতি
বন্ধুত্বের সেই স্তরে পৌঁছে, যখন সবকিছু ভাগ করে নেওয়া যায়, দুজনের মনেই অন্য কিছু দানা বাঁধতে শুরু করেছিল – হয়তো ভালোবাসা। কিন্তু দুজনেই চুপ ছিল। সিয়ার মনে হত হয়তো আরভ এখনও তাকে শুধু বন্ধু মনে করে, আর আরভের ভয় ছিল যদি সিয়া দূরে চলে যায়। দিন কাটতে লাগল, কিন্তু সেই 'আমি তোকে ভালোবাসি' বলার মুহূর্ত আর এল না। শুধু একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে সব কথা বলা, এটাই ছিল তাদের উপায়।
হঠাৎ আসা দূরত্ব
কলেজের তৃতীয় বছর ছিল। হঠাৎ সিয়ার বাবার অন্য শহরে বদলি হয়ে গেল। সিয়াকে কলেজ ছেড়ে যেতে হল। কিছু না বলে, মনের কথা না জানিয়ে, শুধু একটা ছোট্ট বিদায় আর চোখে জল। আরভ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখল, যেন কেউ তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। না ফোন কল, না মেসেজ – দুজনেই নিজেদের জীবনে জড়িয়ে গেল। সময় কাটতে লাগল, কিন্তু মনের মধ্যে একটা কোণ খালি রয়ে গেল।
সময়ের পরীক্ষা
তিন বছর পর, আরভ এখন একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একদিন সে ফেসবুকে সিয়ার একটা ছবি দেখল – একটা বইয়ের স্টলে, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। সে সাহস করে 'Hi' পাঠাল। কিছুক্ষণ পরেই উত্তর এল – 'তুই একটুও বদলাসনি আরভ!' আর তারপর কথার স্রোত শুরু হয়ে গেল। যেন সময় এক মুহূর্তে কয়েক বছরের দূরত্ব মুছে দিল।
পুনরায় সাক্ষাৎ
একদিন সন্ধ্যায়, দুজনে আবার দেখা করল – সেই শহরে, সেই কলেজের পাশের ক্যাফেতে। সিয়া এখন লেখিকা আর আরভ সেই শান্ত ছেলে, শুধু এখন একটু আত্মবিশ্বাসের সাথে। ক্যাফের সেই টেবিলে দুজনে বসেছিল, যেখানে কখনো চা আর বিস্কুটের সাথে স্বপ্ন ভাগ করে নিত। এখন কথায় পরিণতভাব ছিল, কিন্তু সেই সারল্যও বজায় ছিল।
অবশেষে মনের কথা
এইবার আরভ নীরবতা ভাঙল। সে বলল, 'তোকে হারানোর পরেই বুঝেছিলাম আমি তোকে কতটা ভালোবাসি… আর এখনও বাসি।' সিয়া হাসল আর বলল, 'যদি তুই সেদিন বলতে, তাহলে আমি কখনোই যেতাম না। কিন্তু হয়তো এটাই ঠিক ছিল। সময় আমাদের শিখিয়েছে যে যেটা সত্যি হয়, সেটা ফিরে আসে।' আরভের চোখে ছিল আলো আর সিয়ার হাসিতে ছিল শান্তি। তারা প্রথমবার মন খুলে একে অপরের হাত ধরল।
ভালোবাসা যা সময় থেকেও শক্তিশালী
আজ আরভ আর সিয়ার বিয়ের দুই বছর হয়ে গেছে। তারা সেই সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখেছে যাকে সময় আর দূরত্ব পরীক্ষা করেছে। তাদের ভালোবাসা শুধু প্রকাশের উপর নয়, বোঝাপড়া, সম্মান আর বন্ধুত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গল্প বলে যে সত্যিকারের সম্পর্ক কখনো হারায় না, শুধু সময়ের সাথে গভীর হয়। সেই ছেলে আর সেই মেয়ে – যারা কখনো শুধু বন্ধু ছিল, আজ একে অপরের জীবন।
এই গল্প আমাদের শেখায় যে প্রতিটি সম্পর্কের সময় লাগে, বোঝাপড়া লাগে আর সবচেয়ে বেশি – সততা। ভালোবাসা যখন মন থেকে হয়, তখন সে দুনিয়ার বাঁধাকে ভয় পায় না। আরভ আর সিয়ার মতো অসংখ্য মানুষ আমাদের পৃথিবীতে আছে, যাদের গল্পে নীরবতাও কথা বলে আর চোখও প্রকাশ করে।