সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ, নিয়োগ পরীক্ষার আগে বাড়ছে আইনি অনিশ্চয়তা
সেপ্টেম্বরের নিয়োগ পরীক্ষা সামনে
আগামী ৭ ও ১৪ সেপ্টেম্বর স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই নতুন করে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ল গোটা প্রক্রিয়া। সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, যাঁরা ‘টেন্টেড’ বা নিশ্চিতভাবে অযোগ্য প্রার্থী হিসাবে চিহ্নিত, তাঁরা পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। এই অবস্থায় হাজারো চাকরিপ্রার্থীর চোখ এখন আদালতের রায়ের দিকে।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ
সোমবার বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি অরবিন্দ কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, ‘টেন্টেডরা কোনও ভাবেই এই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না।’ তবে ঠিক কোন মানদণ্ডে প্রার্থীদের ‘টেন্টেড’ হিসাবে ধরা হচ্ছে, তা নিয়ে আদালত মন্তব্য করেনি। বরং জানিয়ে দিয়েছে, এই ব্যাখ্যা ও বিচার করার দায়িত্ব কলকাতা হাইকোর্টের। ফলে পরীক্ষার আগে নতুন অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা তৈরি হল।
মামলার সূত্রপাত সোনালি দাস
২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চাকরি পান সোনালি দাস। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁকে ‘ওএমআর মিসম্যাচ’-এর ভিত্তিতে ‘টেন্টেড’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এর ফলে তিনি চাকরি হারান। সোমবার তাঁর আইনজীবী শুভাশিস ভৌমিক সুপ্রিম কোর্টে দাবি করেন, তাঁর মক্কেলের প্রাপ্ত নম্বর কাট অফ মার্কসের সমান হলেও তাঁকে অন্যায়ভাবে অযোগ্য করা হয়েছে। আদালতের রায় মেনে তাঁর চাকরি চলে গেছে, এখন আবার নতুন পরীক্ষায় বসার সুযোগও হারাচ্ছেন তিনি।
আদালতের সামনে নতুন প্রশ্ন
শীর্ষ আদালতে সওয়াল করেন শুভাশিস ভৌমিক—‘‘আমার মক্কেলকে কখনও সিবিআই ডেকে পাঠায়নি, এমনকি কোনও নোটিসও দেওয়া হয়নি। তা হলে কীভাবে তাঁকে ‘টেন্টেড’ ধরা হল?’’ তিনি যুক্তি দেন, এটি প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মূলনীতির লঙ্ঘন। কারও অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই তাঁকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বিচারপতিদের মন্তব্য, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হাইকোর্টের দায়িত্ব, সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে অন্তর্বর্তী হস্তক্ষেপ করবে না।
নতুন করে আইনি জটের সম্ভাবনা
আইনজ্ঞদের মতে, সোনালি দাসের মতো আরও অনেক প্রার্থী আছেন যাঁরা নিজেদের ‘টেন্টেড’ তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাতে পারেন। তাঁরা হয়তো পৃথকভাবে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন। এর ফলে আসন্ন নিয়োগ পরীক্ষা নতুন করে আইনি জটিলতায় আটকে যেতে পারে। ফলে সময় মতো পরীক্ষা আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
৬,২৭৬ জনকে ‘টেন্টেড’ ঘোষণা
প্রসঙ্গত, গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের রায়ে ৬,২৭৬ জন প্রার্থীকে ‘টেন্টেড’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৪,০৯১ জন ওএমআর মিসম্যাচ, ১,৪৯৮ জন প্যানেল বহির্ভূত নিয়োগ এবং ৯২৬ জন র্যাঙ্ক জাম্পের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই তালিকা সিবিআইয়ের রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি হয় এবং এসএসসি তাতেও সম্মতি জানায়।
হাইকোর্টের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
তবে এখানেই শেষ নয়। আইনজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা, ২০১৬ সালের পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ভুল প্রমাণিত হওয়ায় কয়েকজন প্রার্থী পরে অতিরিক্ত নম্বর পেয়েছিলেন। সেই বিষয়টি সিবিআইয়ের তদন্তে ধরা হয়নি। অথচ তাঁদেরও ‘টেন্টেড’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে এঁরা আদালতে গিয়ে আলাদা মামলা করতে পারেন এবং হাইকোর্টকে বাধ্য হতে হবে তাঁদের বক্তব্য শুনতে।
চাকরিপ্রার্থীদের উদ্বেগ
এই পরিস্থিতিতে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। যাঁরা আগে থেকেই মামলায় জড়িয়ে চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের পাশাপাশি এখন নতুন আবেদনকারীরাও নিশ্চিত নন যে, শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে কি না। অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মামলা ও রায়ের ধাক্কায় তাঁদের জীবনযাত্রা অস্থির হয়ে পড়েছে।
প্রশাসনিক দুশ্চিন্তা
এসএসসি-রও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। একদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে হবে, অন্যদিকে পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও নির্ধারিত সময়সূচি বজায় রাখতে হবে। নতুন মামলা এলে পুরো প্রক্রিয়া আবারও আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ঝুলে যেতে পারে। প্রশাসনিক মহলে তাই টানটান উত্তেজনা।
শেষ কথা
সব মিলিয়ে আসন্ন ৭ ও ১৪ সেপ্টেম্বরের এসএসসি নিয়োগ পরীক্ষা ঘিরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। কারা ‘টেন্টেড’, আর কারা প্রকৃত যোগ্য প্রার্থী—তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখন কলকাতা হাইকোর্টের উপর নির্ভর করছে। আদালতের রায় ও পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে, বহু প্রতীক্ষিত এই নিয়োগ পরীক্ষা নির্দিষ্ট দিনে সম্পন্ন হবে, নাকি আরও একবার আইনি লড়াইয়ের জালে আটকে যাবে।