আমেরিকা ও চীনের মধ্যে আরও একবার বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন থেকে আমদানিতে ১০০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর চীন জানিয়েছে যে তারা "বাণিজ্য যুদ্ধকে ভয় পায় না।" বেইজিং আমেরিকার বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতি অবলম্বনের অভিযোগ এনেছে, যার ফলে বৈশ্বিক বাজারে ব্যাপক পতন এবং ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে।
বাণিজ্য যুদ্ধ: আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের আগুন আবার জ্বলে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার চীন থেকে আসা পণ্যের উপর ১০০% পর্যন্ত নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেছেন, যার জবাবে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে যে "আমরা বাণিজ্য যুদ্ধ চাই না, তবে ভয়ও পাই না।" বেইজিং আমেরিকার বিরুদ্ধে বৈষম্য ও দ্বৈত নীতি অবলম্বনের অভিযোগ এনেছে। চীন বলছে যে তাদের বিরল মৃত্তিকা (Rare Earth) রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বৈধ। এই উত্তেজনার কারণে বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এবং আমেরিকান ইক্যুইটি মূল্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক
ট্রাম্প শুক্রবার তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ পোস্ট করে বলেছেন যে চীন থেকে আসা সমস্ত প্রধান আমদানি করা পণ্যের উপর এখন ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত চীন কর্তৃক বিরল মৃত্তিকা খনিজ (Rare Earth Minerals) রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর পর নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি শিল্পে এই খনিজগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং চীন এদের উৎপাদন ও সরবরাহের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব রাখে। চীনের এই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় প্রযুক্তি সংস্থাগুলির মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে কারণ এতে সরবরাহ শৃঙ্খলে গভীর প্রভাব পড়তে পারে।
শেয়ার বাজারে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি
ট্রাম্পের বিবৃতির পর আমেরিকান শেয়ার বাজারে ব্যাপক পতন দেখা গেছে। একদিনেই প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার মূল্য মুছে গেছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে যে এই নতুন শুল্কের পর্যায় বিশ্ব বাণিজ্যকে আবারও ধাক্কা দিতে পারে। চীন ট্রাম্পের পদক্ষেপকে একতরফা এবং স্বেচ্ছাচারী বলে অভিহিত করেছে। বেইজিং বলেছে যে আমেরিকার এমন সিদ্ধান্ত উভয় দেশের মধ্যে সংলাপের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চীন তার নিয়মাবলীকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছে
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নিয়মাবলীকে সম্পূর্ণ বৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মতে, এই নিয়ন্ত্রণগুলি কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং তাদের রপ্তানি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নেওয়া একটি পদক্ষেপ।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যে বিদেশী সংস্থাগুলি চীন থেকে ০.১ শতাংশ বা তার বেশি বিরল মৃত্তিকাযুক্ত পণ্য রপ্তানি করবে, তাদের এখন লাইসেন্স নিতে হবে। মন্ত্রণালয় স্পষ্ট জানিয়েছে যে যে সংস্থাগুলি নিয়মাবলী মেনে চলবে, তাদের লাইসেন্স পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে, যে পণ্যগুলি অস্ত্র বা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেগুলির জন্য লাইসেন্স জারি করা হবে না।
আমেরিকা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে
আমেরিকান ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ জেমিসন গ্রিয়ার বলেছেন যে চীন এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো পূর্ব তথ্য জানায়নি। তিনি এটিকে "পাওয়ার গ্র্যাব" অর্থাৎ শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। আমেরিকার বক্তব্য হলো, চীন এই নীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান চেম্বার অফ কমার্সও চীনের এই পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির মতে, নতুন নিয়মের কারণে রপ্তানি লাইসেন্স আবেদনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর হয়ে গেছে এবং এর ফলে ইউরোপের অনেক প্রযুক্তি সংস্থাকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এখন পোর্ট ফি নিয়ে নতুন বিতর্ক
উত্তেজনা শুধু বিরল মৃত্তিকাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। চীন আমেরিকান জাহাজগুলির উপর নতুন পোর্ট ফি আরোপের ঘোষণা করেছে, যা ১৪ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে। বেইজিং এটিকে "প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেছে এবং বলেছে যে এটি আমেরিকার অনুরূপ শুল্ক সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে। চীন বলছে যে আমেরিকার নীতি আলোচনার পরিবেশকে নষ্ট করছে এবং এর ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব পড়তে পারে।
উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে
এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেও, উভয় দেশের মধ্যে আলোচনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মে মাসে জেনেভায়, জুনে লন্ডনে এবং জুলাই মাসে স্টকহোমে তিন দফা কূটনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় পক্ষ TikTok ডিভেস্টমেন্ট নিয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছিল, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান পাওয়া যায়নি।
১৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প এবং শি জিনপিংয়ের মধ্যে ফোনে কথা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প বলেছিলেন যে উভয় নেতা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংজুতে APEC বৈঠকের সময় দেখা করতে পারেন, তবে চীনের নতুন সিদ্ধান্তের পর ট্রাম্প এই বৈঠক বাতিল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে বাণিজ্য যুদ্ধ
আমেরিকা ও চীনের মধ্যে এই নতুন অর্থনৈতিক সংঘাত কেবল বাণিজ্যিক শুল্ক বা ট্যারিফের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি এখন প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। উভয় দেশ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে। বেইজিং বলছে যে আমেরিকা ক্রমাগত চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে থামানোর চেষ্টা করছে, যখন আমেরিকার অভিযোগ যে চীন তার নীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে অন্যায়ভাবে সুবিধা বজায় রাখতে চাইছে।