বর্ধমানের মাটিয়াল ডিভিসি মোড়ে মঙ্গলবার সকাল সাতটা। দিনের প্রথম আলো ফোটার আগেই জিটি রোডে দাঁড়িয়ে যায় স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একঝাঁক ছাত্রী। দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইওভারের দাবি জানিয়ে আসছিল তারা। প্রশাসনের গড়িমসি আর প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়াতেই এবার চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হল ছাত্রীমহল। তাদের দাবি, ফ্লাইওভার না থাকায় প্রতিদিন তিন কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে যেতে হয়। এতে যেমন দেরি হয়, তেমনি ক্লান্তিও চেপে বসে। অবরোধকারীদের স্পষ্ট হুঁশিয়ারি—প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে।
আন্ডারপাস ভরা জল, স্কুলপথে দুর্ভোগ—পড়ুয়ারা বলছে, ‘আর নয়!’
বর্ধমানের ফ্লাইওভার না থাকা ছাড়াও আরও একটি বড় সমস্যা তুলে ধরেছেন ছাত্রীদের একাংশ। এলাকায় যে আন্ডারপাস রয়েছে, সেটি প্রায় সময় জলের তলায় থাকে। ফলে সেই পথ দিয়ে যাতায়াত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়েই দীর্ঘ ঘুরপথ নিতে হয়। স্কুলে পৌঁছনোর সময় দেরি, ফেরার সময় ক্লান্তি আর ভেজা পোশাক—এই দুর্বিষহ রুটিনই এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রশাসনের নীরবতা ভেঙে এবার সরাসরি রাস্তায় নেমে গর্জে উঠেছে এই কিশোরী কণ্ঠস্বর।
অবরোধ সামাল দিতে আসরে বর্ধমান থানার বড় বাহিনী, প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ ওঠে
ছাত্রীদের এহেন সক্রিয় প্রতিবাদে তৎপর হয় প্রশাসনও। বর্ধমান থানার পুলিশবাহিনী পৌঁছয় অবরোধস্থলে। পরিস্থিতি যাতে উত্তপ্ত না হয়, সেই লক্ষ্যে পুলিশ চেষ্টা করে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সামাল দেওয়ার। অবশেষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে ফ্লাইওভার নির্মাণের বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রীরা শান্তভাবে অবরোধ তুলে নেয়। GT রোড ফের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে, তবে প্রশাসনের কাছে ছাত্রীদের এই হুঁশিয়ারি এক শক্ত বার্তা হয়ে রয়ে গেল।
এদিকে ঘাটালে রাস্তায় কাদা, পড়ে যাচ্ছে পড়ুয়ারা—বেহাল রাস্তায় ধ্বস্ত সুলতানপুরের ছাত্রছাত্রীদের জীবন
পূর্ব বর্ধমানের পর এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। সুলতানপুর এলাকার রাস্তার হাল এতটাই খারাপ যে স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ুয়ারা প্রায় রোজই পিছলে পড়ছে কাদামাটির ওপর। মঙ্গলবার সকাল দশটা থেকে রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামে সুলতানপুর হাইস্কুল এবং আশপাশের দু'টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। রাস্তার মাঝে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের মুখে একটাই স্লোগান—“আমরা রাস্তা চাই!” দিনের ব্যস্ত সময়ে হওয়ায় অবরোধে আটকে পড়ে বহু বাস, ট্রাক ও জরুরি পরিষেবা।
অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের এককাট্টা সমর্থন, প্রশাসনের ‘না-দেখা’র প্রতিবাদে পথ অবরোধ
শুধু পড়ুয়ারাই নয়, অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দারাও সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সবার বক্তব্য, বছরের পর বছর ধরে বারবার জানানো সত্ত্বেও রাস্তা সারানো হয়নি। বর্ষায় রাস্তাগুলি এমন কাদায় পরিণত হয় যে শিশুদের স্কুলে পৌঁছনো প্রায় যুদ্ধসম। বিজেপি পরিচালিত সুলতানপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান কৌশিক জানা নিজে জানিয়েছেন, জেলা পরিষদ এবং ব্লক প্রশাসনকে একাধিকবার জানানোর পরও কোনও সাড়া মেলেনি। তাই বাধ্য হয়েই এই আন্দোলন।
বিডিও’র স্বীকারোক্তি—দাবি সত্য, রাস্তা খারাপ, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে
ঘটনা নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিডিও অভীক বিশ্বাস বলেন, “পড়ুয়াদের দাবি একেবারেই ঠিক। বন্যার ফলে রাস্তায় বিছানো মোরাম উঠে গেছে, ফলে রাস্তা কাদা জমে হাঁটাচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।” তিনি আশ্বস্ত করেছেন, রাস্তা সারানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঘটনাস্থলে জয়েন্ট বিডিও গেছেন ও পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে অবরোধ তোলার চেষ্টা করছেন।
একই দিনে দুই জেলায় ছাত্রীদের প্রতিবাদে শিক্ষা খাতের পরিকাঠামোর প্রশ্নে চাপে প্রশাসন
ফ্লাইওভার না থাকায় তিন কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে যাওয়া, কাদা রাস্তায় পিছলে পড়ে যাওয়া, আন্ডারপাসে জলের ঢল—একুশ শতকে দাঁড়িয়ে স্কুলে যেতে এমন দুর্ভোগ আর কতদিন? একদিকে ডিজিটাল ক্লাস, অন্যদিকে জল-কাদা ঠেলে স্কুলে পৌঁছনোর লড়াই। মঙ্গলবারের এই বিক্ষোভ যেন স্পষ্ট করে দিল—পরিকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার প্রসার সম্ভব নয়। প্রশাসন যদি এখনই না জাগে, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় আন্দোলনের মুখে পড়তে হতে পারে।