ভারতীয় বাজারে প্রবেশ নিয়ে ইলন মাস্কের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। কিন্তু বাজারের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে শুরুটা আশানুরূপ হয়নি। একদিকে প্রচুর প্রচার, অন্যদিকে গ্রাহকের বাস্তব চাহিদা—দুটোর মধ্যে ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
টেসলার ভারত প্রবেশ: ধুমধাম করে সূচনা
গত ১৫ জুলাই মুম্বইয়ের বুকে প্রথম শোরুম খুলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় বাজারে আত্মপ্রকাশ করে টেসলা। সঙ্গে লঞ্চ করা হয় Model Y গাড়ি। ইলেকট্রিক ভেহিকেল নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই মাস্কের এই পদক্ষেপ। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতেই দেখা যাচ্ছে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বেশ অমিল।
দেড় মাসেও সাড়া নেই: বুকিং সংখ্যা হতাশাজনক
ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, লঞ্চের পর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও টেসলা মাত্র ৬০০টিরও বেশি গাড়ির অর্ডার পেয়েছে। এমন এক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য এটি একেবারেই নগণ্য। কোম্পানি যে সাড়া আশা করেছিল, বাস্তবে তার তুলনায় এটি অনেকটাই কম।
সীমিত শহরে সীমাবদ্ধ ডেলিভারি পরিকল্পনা
প্রাথমিকভাবে টেসলার ডেলিভারি শুরু হবে মুম্বই, দিল্লি, পুনে ও গুরুগ্রামে। অর্থাৎ দেশের বিস্তীর্ণ বাজারে প্রবেশের আগেই টেসলা নিজেদের গুটিয়ে ফেলছে সীমিত শহরে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দ্বিতীয় শোরুম দিল্লিতে, গুরুগ্রামে প্রস্তুতি জোরকদমে
মুম্বইয়ের পর দিল্লিতে খুলেছে টেসলার দ্বিতীয় শোরুম। পাশাপাশি গুরুগ্রামে শিগগিরই গাড়ি আমদানি ও প্রদর্শনের কাজ শুরু হবে। তবে এত কিছু করেও যদি বুকিং সংখ্যা না বাড়ে, তা হলে এটি মাস্কের ভারত মিশনের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কবে শুরু হবে ডেলিভারি?
কোম্পানির পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক থেকেই ডেলিভারি শুরু করা হবে। তবে আপাতত শুধুমাত্র চারটি বড় শহরেই ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকবে। দেশের অন্যান্য প্রান্তে কখন গাড়ি পৌঁছবে তা এখনও স্পষ্ট করে জানায়নি টেসলা।
দামই কি প্রধান বাধা?
Tesla Model Y ভারতে লঞ্চ হয়েছে দুটি ভেরিয়েন্টে। স্ট্যান্ডার্ড ভেরিয়েন্টের দাম ৫৯.৮৯ লক্ষ টাকা এবং লং রেঞ্জ ভেরিয়েন্টের দাম ৬৭.৮৯ লক্ষ টাকা (এক্স-শোরুম)। দিল্লিতে অন-রোড মূল্য দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ৬১.০৭ লক্ষ ও ৬৯.১৫ লক্ষ টাকা। এত উচ্চমূল্যের কারণে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা এই গাড়ি নিয়ে ভাবতেও পারছেন না।
আমদানি শুল্কে বাড়ছে বোঝা
টেসলার সব গাড়িই আপাতত সম্পূর্ণ তৈরি অবস্থায় বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। ফলে বিশাল অঙ্কের আমদানি শুল্ক জুড়ে গিয়ে দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টেসলা যদি ভারতে অ্যাসেম্বলি ইউনিট চালু করত, তবে দামের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় নামতে পারত।
সীমিত গ্রাহক গোষ্ঠীকে টার্গেট
টেসলা আপাতত ভারতের সেই গ্রাহক গোষ্ঠীকে টার্গেট করছে, যাদের যাত্রীবাহী গাড়ির বাজারে শেয়ার মাত্র ৪ শতাংশ। ফলে এই সীমিত সেগমেন্টে দাঁড়িয়ে মাস্কের স্বপ্নপূরণ হওয়া বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ব্যাটারি ক্ষমতায় নজরকাড়া, কিন্তু...
Model Y আসছে দুটি ব্যাটারি প্যাক নিয়ে—৬০ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং ৭৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা। প্রথমটি একবার চার্জে ৫০০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম, আর দ্বিতীয়টি ৬২২ কিলোমিটার রেঞ্জ দেয়। প্রযুক্তিগতভাবে আকর্ষণীয় হলেও দাম ও ডেলিভারি সীমাবদ্ধতা গ্রাহকের আগ্রহে ভাটা ফেলছে।
রঙের বৈচিত্র্য, তবু টানছে না ক্রেতা
এই মডেল বাজারে এসেছে সাতটি ভিন্ন বডি কালার এবং দুটি ইন্টেরিয়র থিমের সঙ্গে। তবে ক্রেতারা শুধুই রঙ বা থিম দেখে গাড়ি কিনবেন না—এমনটাই মনে করছেন শিল্প বিশ্লেষকরা। উচ্চমূল্য ও সীমিত উপস্থিতিই হয়ে উঠছে প্রধান বাধা।
ভারতের ইভি বাজারে প্রতিযোগিতার ছবি
বর্তমানে ভারতীয় বাজারে টাটা, মহিন্দ্রা থেকে শুরু করে হুন্ডাই—সবাই ইলেকট্রিক ভেহিকেলের দৌড়ে রয়েছে। তুলনামূলক কম দামের মডেলেই তারা দখল করে নিচ্ছে বাজার। সেখানে টেসলার মতো প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের প্রবেশে সাড়া মিলছে কম, যা বাজারের বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করছে।
ভবিষ্যৎ কোন পথে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, টেসলার সামনে দুটি রাস্তা খোলা—এক, ভারতের মতো বৃহৎ বাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু করে দামের ভার কমানো; দুই, সীমিত গ্রাহক সেগমেন্টেই নিজেদের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কোন পথে হাঁটবে মাস্ক, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ভারতীয় বাজার কি তবে ভরসা হারাচ্ছে টেসলায়?
প্রথম পর্যায়ের ফলাফল একেবারেই আশানুরূপ নয়। গ্রাহক সাড়া না মেলার পাশাপাশি সীমিত বুকিং সংখ্যা নিয়ে চাপের মুখে টেসলা। মাস্কের স্বপ্ন কি তবে ভারতের মাটিতে ধাক্কা খেল? নাকি এটি শুধুই শুরু, ভবিষ্যতে নতুন কৌশল নিয়েই টেসলা ঘুরে দাঁড়াবে—সময়ের অপেক্ষা।