সার প্রক্রিয়া নিয়েই ধোঁয়াশা
বাংলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (সার) কবে থেকে শুরু হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণ জানায়নি। তবে রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যেই উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
বিজেপির দাবি ও তৃণমূলের পাল্টা হুঁশিয়ারি
বিরোধী বিজেপির দাবি, বাংলায় সার হলে অন্তত এক কোটি নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। অন্যদিকে শাসকদল তৃণমূলের হুঁশিয়ারি, বৈধ ভোটারের নাম যদি একটিও বাদ পড়ে, তবে তার কড়া জবাব দেওয়া হবে। বিহারের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, সেখানে সার প্রক্রিয়ায় ৬৫ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছে। ফলে বাংলার ক্ষেত্রেও একই ছবি দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল কী বলছে?
‘ইলেক্টোরাল রোল ইনফ্লেশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল/আ ডেমোগ্রাফিক রিকনস্ট্রাকশন অফ লেজিটিমেট ভোটার কাউন্ট (২০২৪)’ শীর্ষক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গবেষকরা বলছেন, জন্ম–মৃত্যুর হার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভিন রাজ্যে স্থায়ী অভিবাসনের হিসাব মিলিয়ে দেখা গেছে ২০২৪ সালে বাংলার ভোটার তালিকায় অন্তত ১ কোটি ৪ লক্ষ বাড়তি নাম রয়েছে। যা শতাংশের হিসেবে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৩.৬৯।
কারা গবেষণা চালালেন?
এই সমীক্ষা করেছেন মুম্বইয়ের এসপি জৈন ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চের গবেষক বিধু শেখর এবং আইআইএম বিশাখাপত্তনমের শিক্ষক–গবেষক মিলন কুমার। তাঁদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলায় ভোটার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬১ লক্ষ ২৪ হাজার ৭৮০। অথচ পরিসংখ্যানভিত্তিক হিসাব বলছে, এর মধ্যে অন্তত এক কোটির বেশি নাম অপ্রাসঙ্গিক বা অবৈধ।
ভিত্তি বর্ষ হিসেবে কেন ২০০৪?
গবেষকরা তাঁদের পর্যালোচনায় ‘বেস ইয়ার’ হিসেবে ধরেছেন ২০০৪ সালকে। কারণ বাংলায় শেষবার স্পেশাল রিভিশন হয়েছিল ২০০২ সালে। তাই ২০০৪-এর তালিকাকে তুলনামূলকভাবে ‘শুদ্ধ’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। ওই বছর লোকসভা ভোট হয়েছিল এই তালিকার ভিত্তিতেই। তখন রাজ্যের মোট ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লক্ষ।
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণের চিত্র
২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বয়সভিত্তিক সেন্সাস রিপোর্ট কাজে লাগিয়ে গবেষকরা দেখিয়েছেন, ২০০৪ সালে ১৮–২৭ বছর বয়সি ভোটার ছিলেন প্রায় ১ কোটি ৩৪ লক্ষ। অন্যদিকে ৬৮ বছরের ঊর্ধ্বে ভোটারের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭ লক্ষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারের সংখ্যা কমতে থাকে, আর সেই হার ব্যবহার করেই তাঁরা ২০২৪ সালের হিসাব কষেছেন।
টিকে থাকার গড় হিসাব
গবেষণা বলছে, ২০০৪ সালের ৪ কোটি ৭৪ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ২০২৪ সালে টিকে থাকার কথা ছিল প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লক্ষের। এখানে ‘স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ (এসআরএস) ব্যবহার করা হয়েছে বেঁচে থাকার গড় হার নির্ধারণের সূচক হিসেবে। জন্ম সংক্রান্ত তথ্যের জন্য নেওয়া হয়েছে ‘সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ হেল্থ ইনটেলিজেন্স’-এর পরিসংখ্যান। তবে কোভিড-পর্বের অতিরিক্ত মৃত্যুহারকে এর মধ্যে ধরা হয়নি।
নতুন ভোটার যুক্ত হওয়ার অঙ্ক
২০০৪ সালের পর থেকে যাঁদের জন্ম ১৯৮৬ বা তার পরে, তাঁরা প্রতি বছর ১৮ পূর্ণ করে ভোটার তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। আবার ২০০৬ সালের পরে জন্মানো প্রজন্ম ২০২৪-এর পর থেকে ভোটার তালিকায় আসতে শুরু করবে। গবেষণা বলছে, এইভাবে প্রায় ৩ কোটি ৯৪ লক্ষ নতুন ভোটার যুক্ত হওয়ার কথা ছিল।
বাস্তব চিত্রে অমিল
এই অঙ্ক মেলালে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের ভোটার সংখ্যা দাঁড়ানোর কথা ছিল ৬ কোটি ৭৪ লক্ষের কিছু বেশি। কিন্তু এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কর্মসূত্রে ভিন রাজ্যে বা বিদেশে চলে গিয়েছেন। ২০১১–র পর থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।
অভিবাসনের প্রভাব
গবেষণায় ‘কমপাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট’ ধরে হিসাব কষে বলা হয়েছে, প্রায় ১৭ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে রাজ্য ছেড়ে গিয়েছেন। তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরও রাজ্যে ভোটার সংখ্যা হওয়া উচিত ছিল প্রায় ৬ কোটি ৫৭ লক্ষ।
প্রশ্ন তুলছে অতিরিক্ত ভোটার
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে বাংলার ভোটার সংখ্যা ৭ কোটি ৬৩ লক্ষ ৯৬ হাজারেরও বেশি। অর্থাৎ এক কোটিরও বেশি ভোটার নাম বাড়তি। প্রশ্ন উঠছে—এই অতিরিক্ত নাম তালিকায় কীভাবে রয়ে গেল?
কমিশনের ব্যাখ্যা
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এখনও বহু মৃত মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায়নি। আবার অনেকের নাম একাধিক জায়গায় রয়ে গিয়েছে। সার প্রক্রিয়া শেষ হলে এগুলি ধরা পড়বে এবং শুদ্ধিকরণ সম্পূর্ণ হবে।
রাজনৈতিক লড়াই আরও তীব্র
এই গবেষণার ফল প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা শুরু হয়েছে। বিজেপি অভিযোগ তুলছে, ভোটার তালিকায় মৃত ও ভুয়ো নাম রেখে তৃণমূল সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে। অন্যদিকে তৃণমূল দাবি করছে, বৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়লে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করা হবে।
সামনে বড় ঝড়?
রাজনীতিকদের অনেকের মতে, সার প্রক্রিয়া কার্যকর হলে বাংলার রাজনীতিতে বড়সড় ধাক্কা লাগতে পারে। এক কোটির বেশি নাম বাদ যাওয়া মানে ভোটের ফলাফলেও ব্যাপক প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাই এই মুহূর্তে সকলের নজর নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের দিকেই।